স্বাধীনতার ৭৫তম দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে গান্ধীজি, নেতাজি, আম্বেদকর এবং সাভারকরকে একই আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। তার মানে গোঁড়া হিন্দুত্ব তত্ত্বের জনক, বিজেপির বিদ্বেষমূলক, বিভেদমূলক আদর্শের আঁতুড়ঘর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণমনা রাজনৈতিক-ধার্মিক দলহিন্দু মহাসভার দীর্ঘকালের সভাপতি, তথা ব্রিটিশদের সহায়ক, ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিরোধীতাকারী বিনায়ক দামোদর সাভারকরও গান্ধীজি-নেতাজির সমতুল্য একজন সংগঠক ও আন্দোলনকারী। এই প্রথম নয়, ২০১৫ সালে সাভারকরের ৩২তম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর ছবির সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে ভারতের ইতিহাসে তাঁর অমূল্য অবদানের কথা বলেছিলেন। ২০১৬-র ২৮শে মে, সাভারকরের জন্মজয়ন্তীতে মোদী নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁকে “ভারতমাতার খাঁটি সন্তান এবং অসংখ্য দেশবাসীর কাছে অনুপ্রেরণা স্বরূপ” ইত্যাদি কথা লিখেছিলেন।

তবে সাভারকরও প্রথম জীবনে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন৷ ১৯০৬ সালে ইংলন্ডে আইন পড়তে যাবার সময়ে সাভারকর ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন, উদ্দেশ্য ছিল ইংলন্ডে ভারতীয় ছাত্রদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত করা। ১৯০৯ সালে নাসিকের কালেক্টর এ এম টি জ্যাকসনকে হত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়ে ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটির এক সদস্য। তদন্তে জানা যায়, তার কাছ থেকে পাওয়া পিস্তলটি জোগাড় করে দিয়েছিলেন সাভারকরই। এই অপরাধে সাভারকরকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়।

কিন্তু ১৯১১ সালের ৩০ আগস্ট সাভারকর ইংরেজ সরকারকে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে চিঠি লেখেন।কিন্তু তাঁর আবেদন ব্রিটিশ সরকার হাতে পাওয়া মাত্র নাকচ করে। ফের তিনি ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে এবং অন্যান্য সহবন্দীরা তাঁর থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন এই অভিযোগ জানিয়ে চিঠি পাঠান ১৯১৪ সালের ১৪ নভেম্বর। তবে দ্বিতীয় চিঠিতে তিনি একথাও জানান যে, ১৯০৬-১৯০৭ সালের দেশের দিশাহীন অবস্থার বশেই তিনি পথ ভুল করে বিপ্লবের পন্থা বেছে নিয়েছিলেন, চিঠিতে ব্রিটিশ সরকারকে তিনি আশ্বস্ত করেন,সরকার বাহাদুর যদি কৃপাবশত তাঁকে ক্ষমা করেন এবং মুক্তি দেন,তবে তিনি কেবল এবং ব্রিটিশ সরকার বাহাদুরের অনুগত, আজ্ঞাবহ সমর্থক হয়ে থাকবেন।

এ ছাড়াও, তাঁর ক্ষমাভিক্ষার চিঠিতে তিনি এমন কিছু প্রস্তাব দেন যা সেই সময়ের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না।তিনি লেখেন, “my conversion to the constitutional line would bring back all those misled young men in India and abroad who were once looking up to me as their guide. I am ready to serve the Government in any capacity they like, for as my conversion is conscientious..The Mighty alone can afford to be merciful and therefore where else can the prodigal son return but to the paternal doors of the Government?” (পেনাল সেটলমেন্টস ইন আন্দামানস, আর সি মজুমদার)।

তার মানে তিনি মনে করেছিলেন, তিনি যা করেছিলেন তা অত্যন্ত ভুল। আর সেই কারণেই তিনি একদা ভারতে এবং বিদেশে তাঁর অনুগামীদেরকেও ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরিয়ে এনে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সুযোগ চেয়েছিলেন। ক্ষমার জন্য কোনও ভিক্ষা, কোনও আবেদন, এর চেয়ে বেশি নীচ, বেশি হীন হতে পারে না৷ সাভারকরের আবেদনের ছত্রে ছত্রে কেবল ক্ষমাভিক্ষা নয়, একজন আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তির আত্মসমর্পণ৷ যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন, সেই দেশে সাভারকর জেল থেকে বাইরে আসার জন্য নীতি–আদর্শ–মর্যাদা– সবই হেলায় বিসর্জন দিয়েছেন৷ বোঝাই যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী নেতা সাভারকর কতবড় দেশপ্রেমিক ছিলেন৷

এরপরও বহুবার সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে আবেদন করে জানিয়েছেন, “…কোনও প্রতিশ্রুতি যা সরকার বাহাদুর লিখিয়ে নিতে চান,সরকারের ইচ্ছেমত যে কোনও রকম শর্ত, সর্বতোভাবে, আমি ও আমার ভাই, দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে সানন্দে মেনে নিতে রাজি আছি”। অবশেষে, দশ বছর সেলুলার জেলে কাটাবার পর সাভারকর এবং তাঁর ভাই, ১৯২১ সালে রত্নগিরির একটি জেলে স্থানান্তরিত হন, এবং রত্নগিরি জেলার বাইরে কখনও পা ফেলবেন না, আর, জীবনে কখনও কোনও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সাথে নিজেকে যুক্ত করবেন না– এই শর্তে রাজি হবার পর ১৯২৪ সালে তাঁরা দুই ভাই মুক্তি পান।

প্রশ্ন এমন এক ব্রিটিশের পা-চাটা দালাল “বীর” উপাধি পেলেন কিভাবে ?১৯২৬ সালে প্রথম সাভারকরকে নিয়ে জীবনীমূলক বই ‘লাইফ অফ ব্যারিস্টার সাভারকর’ লেখক চিত্রগুপ্ত প্রকাশিত হয়। এই বইতে-“সাভারকর আজন্ম এক সাহসী নায়ক, ফলাফলের তোয়াক্কা না করেই তিনি যে কোনও কাজের দায়িত্ব নিয়ে তা সম্পূর্ণ করতে পিছপা হতেন না। সরকারের যে নিয়ম বা আইন তাঁর কাছে সঠিক বা বেঠিক ভাবে অন্যায় মনে হত, তৎক্ষণাৎ সেই অশুভ নিয়মকে সমাজের বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য তিনি যে কোনও পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা বোধ করতেন না।” কিন্তু সাভারকরের মৃত্যুর বছর কুড়ি পরে, সাভারকর ফাউন্ডেশন ১৯৮৭ সালে ওই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত করেএবং ফাউন্ডেশনের সম্পাদক রবীন্দ্র রামদাস জানান, বইটির লেখক, “চিত্রগুপ্ত, স্বয়ং সাভারকর ব্যতীত আর কেউ নয়”

মোদী যাকে নেতাজি আর গান্ধীজির সঙ্গে একাসনে বসালেন সেই সাভারকর ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মহাসভার কলকাতা অধিবেশনের বক্তৃতায় সাভারকর বলেন, দেশের সমস্ত কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অতি অবশ্যই যেন যুবকদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনিতে যোগ দেবার জন্য উৎসাহ জোগায়। গান্ধীজী ব্যক্তিগত স্তরে সত্যাগ্রহ আরম্ভ করলে সাভারকর মাদুরাতে এক জনসভায় যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনিতে যোগদান করতে আহ্বান জানালেন। নেতাজী ব্রিটিশকে শেষ ধাক্কা দেবার উদ্দেশ্যে যখন সেনাবাহিনি গড়ে তুলছেন অন্যদিকে সাভারকর ব্রিটিশ সেনাবাহিনির জন্য হিন্দু যুবকদের রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পের আয়োজন করছিলেন, যাতে তারা উত্তর-পূর্ব ভারতে ঢুকে পড়া আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের কচুকাটা করতে পারা যায়। সাভারকর মাদুরার এক সভায় নিজেই জানান, স্রেফ এক বছরে তিনি এক লাখ হিন্দুকে ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনিতে ভর্তি করিয়েছেন।
Share.

3 Comments

  1. avijit sengupta on

    বিজেপি ও তার চালক আর এস এস ‘দেশপ্রেম’–এর ধুয়ো তুলে দেখাতে চাইছে সংঘ পরিবারই সাচ্চা দেশপ্রেমিক৷ কিন্তু বিজেপি জানে যে ধর্মীয় জিগির তৈরি করে দু–একটা নির্বাচন হয়ত পার করা যায়, বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না৷

  2. anurup mandal on

    সংঘ পরিবারের দেশ সেবকরা দেশভাগের জন্য একতরফা ভাবে মুসলিম লিগ ও মুসলিম মৌলবাদী শক্তিগুলিকেই দায়ী করে৷ কিন্তু ১৯২৩ সালেই হিন্দু মহাসভার নেতা বি ডি সাভারকার ধর্মভিত্তিক পৃথক দেশের ধারণা উপস্থিত করেছিলেন৷ তিনি ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে ভারতবর্ষে হিন্দু এবং মুসলিম দুটি পৃথক জাতির তত্ত্ব পেশ করেন৷

  3. Jyotirmoy Bhattacharya on

    এই মোদীরা একই দিনে গান্ধীজী আর সাভারাকারকে ফুল মালা দেয়। মানে যিনি খুন হলেন আর খুনী দুজনের ছবিতেই।
    এরা শয়তানের অবতার, সারাদেশ সারাপৃথিবীর মানুষের পক্ষেই বিপজ্জনক।

Leave A Reply

Exit mobile version