‘আমার জীবনে সঞ্চিত মালমসলাকেই আমি মুখ্যত কাজে লাগাই।’-ম্যাক্সিম গোর্কি। তিনি বলতে চেয়েছেন যে তাঁর লেখায় বানানো কিংবা কল্পনাপ্রসূত কিছু নেই; যা আছে সব নিজের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকেই নেওয়া। এই বাস্তবতার সাক্ষী হিসেবে জোরালোভাবে তাঁর যে সাহিত্য কীর্তিকে দাঁড় করানো যায়,  তা হল ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘পৃথিবীর পথে’ আর ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’।এই সবের ভিতরে যত মানুষ আমরা দেখি, তাঁরা সবাই স্বনামে হাজির। ঐতিহাসিক চরিত্র, নেতা, সংগঠক বা বিপ্লবী সবাই গোর্কির প্রত্যক্ষ বাস্তব।

তলস্তয় ও গোর্কির আত্মজীবনী বা আত্মজৈবনিক উপন্যাস পুরোপুরি এক নয়, ধাঁচও আলাদা। আত্মজীবনীতে উত্তম পুরুষে না বলে গত্যন্তর থাকে না, কিন্তু এমন উপন্যাসও তো অগণিত রয়েছে, যেখানে কাহিনির বয়ান উত্তম পুরুষে, নায়ক-নায়িকার জবান ও দৃষ্টিকোণ থেকে। এই সাধারণ লক্ষণে এদের চরিত্র শনাক্ত করা যাবে না। প্রধান পার্থক্য ঘটনা উপস্থাপনে ও বর্ণনার ভঙ্গিতে দেখা যায়। আত্মজীবনীর এক সাধারণ লক্ষণ সম্ভবত সমতলতা, মন্থর প্রবহমানতা ও কাহিনির একরৈখিকতা।

লক্ষণীয় যে গোর্কির তিনটি অংশই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন তুলেছিল। তাঁর সমকাল এগুলিকে স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী হিসেবে গণ্য করেনি। সমবয়সী ছোটগল্পকার মিখাইল প্রিশভিন‘আমার ছেলেবেলা’কে বলেছিলেন, ‘অসম্ভব ভালো বই…’। উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন কর্নেই চুকোভস্কি, ‘গোর্কি ইতিপূর্বে কখনো এমন খোলামেলা, তাজা ও মনোমুগ্ধকর কাহিনি লেখেননি। এযাবৎ তিনি যা কিছু করেছেন, তার ভেতরে এটিই শ্রেষ্ঠ।’ আর আর্মেনীয় সাহিত্যিক শির্ভানজাদেহ লিখেছিলেন, ‘আমার বিবেচনায় পুরো বইটি রুশ জনগণের জীবন, তাদের নির্যাতনের প্রতীক। সত্যি কথা বলতে প্রতীক সব জাতিরই।’

গোর্কি যখন তাঁর আত্মজৈবনিক রচনাপ্রকাশ করেন, তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। তত দিনে তিনি তলস্তয়, চেখভ, লেনিন, এইচ জি ওয়েলস, প্লেখানভ প্রমুখের ভীষণ অন্তরঙ্গ। এই তিনটি বই ওই অর্থে উপন্যাস নয়, যে বিচারে মা কিংবা ক্লিম সামগিন বা আর্তামোনভদের ক্রিয়াকলাপ উপন্যাস। তবু ১০-১২ বছর ধরে লেখা এই তিনটির প্রতিটি খণ্ড বিশ্বব্যাপী গোর্কির অভাবনীয় ও বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

বস্তুতপক্ষেএই তিন রচনা গোর্কির আত্মার ছাল ছাড়ানো দলিল। গোর্কি তাঁর পথচলার কাহিনিই লিখে গিয়েছেন। আমার ছেলেবেলাতেই গোর্কি লিখেছিলেন, ‘…আশ্বাস জাগে যে একদিন না একদিন আমাদের দেশের মানুষ এক পূর্ণ প্রস্ফুটিত জীবনের সৌন্দর্যে ও উজ্জ্বল মানবিকতায় অধিষ্ঠিত হবে।’ তবে গোর্কি রুশ বিপ্লবের প্রতি সমর্থন জানালেও বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের সব কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় মেনে নেননি। বলশেভিকদের নানান বিষয়ে দ্বিমত জানিয়ে লিখেছেন কলাম। তাঁর সেই সব আক্রমণাত্মক নিবন্ধ পড়ে জোসেফ স্তালিনের মন্তব্য ছিল, যদি গোর্কি বিপ্লবের পথ পরিহার করেন, তবে তিনি নিক্ষিপ্ত হবেন বিস্মৃতির গর্ভে। কিন্তু লেনিনের প্রতি গোর্কির শ্রদ্ধাবোধ বরাবরই অটুট ছিল। লেনিনের কাছে একাধিক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে গোর্কি একের পর এক চিঠিও লিখেছিলেন। অনেক সময়েই কোনো কবি,  বিজ্ঞানী বা লেখক বন্ধুর গ্রেপ্তারের খবর জানতে পেরে তাঁদের দ্রুত মুক্তির অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। কখনো বা বই প্রকাশনায় আমলাতান্ত্রিক বাধানিষেধের গেঁড়োতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তা দূর করতে লেনিনকে আহ্বান জানিয়েছেন। লেনিন যে তাঁর চিঠিকে উপেক্ষা করতেন, তা নয়। যতখানি সম্ভব ব্যবস্থা নিতেন। তবে লেনিনের মৃত্যুর পর, স্তালিন যখন সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বেসর্বা, সে সময় গোর্কি আর এমন ভূমিকায় সরব ও সক্রিয় থাকতে পারেননি।

গোর্কি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। লেনিন তাঁকে চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠিয়েছিলেন। সাত বছর নানা জায়গায় কাটিয়ে স্বদেশে ফিরলেও নিরাময় হয়নি। যক্ষ্মার চিকিৎসা চলার সময়ই ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান। সরকার গোর্কির চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার অভিযোগ আনে। কয়েকজনকে শাস্তিও দেওয়া হয়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতাকেও সন্দেহের তালিকায় এনে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মনে করা হয়, এটি স্তালিনেরই কাজ; পার্টির কুকর্মের একজন দৃঢ়চেতা সমালোচককে সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অপছন্দের ব্যক্তিদেরও দল থেকে উৎখাত করার জন্য তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন।

ম্যাক্সিম গোর্কির ব্যক্তিগত বন্ধু ফরাসি লেখক আঁন্দ্রে জিদ বলছেন, ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন অফ রাইটার্সের তরফ থেকে গোর্কির মৃত্যুর পর একটি শোকপ্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল-গোর্কির শেষ ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়নি রাশিয়ার সরকার।রাশিয়ার সর্বাধিনায়ক স্তালিন একদিন ম্যাক্সিম গোর্কির কাছে গিয়ে একান্তে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর জীবনী লিখে দেওয়ার জন্য। স্তালিনের সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন গোর্কি। তিনি বিশ্বাস করতেন, লেখকের কাজ স্তাবকতা করা নয়, রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে উপহার নিয়ে তাঁকে খুশ করা নয়, সুবিধা নেওয়া নয় কিংবা তাঁর কথামতো জীবনী লিখে দেওয়া নয়। ১৯৩৬ এর ১৮ জুন মস্কো রেডিও ঘোষণা করল, “ম্যাক্সিম গোর্কি মারা গেছেন।”খবর শুনে সারা রাশিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল।

১৯৩০ সালের পরবর্তী সময়ে ‘White sea canal campaign’ কে কেন্দ্র করে গোর্কির সঙ্গে স্তালিনের মতপার্থক্য তৈরি হয়। শ্বেত সাগর এবং বল্টিক সাগরের সংযোগ একটি খাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে রাশিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২২৭ কিলোমিটার ওই ক্যানেলনির্মাণে ১ লাখ ২৬ হাজার “ফোর্সড লেবার” নিয়োগ করা হয়। স্তালিন বিরোধীরা ছিলেন এই ফোর্সড লেবার। জারি হয়েছিল একটি নির্যাতনমূলক আইন ‘গুলাগ’। যাতে পাঠিয়ে দেওয়া হত সাইবেরিয়ায়। ফোর্সড লেবারদের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে ঠাণ্ডাও অনাহারে। যার দায়িত্বে ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীনস্ত এনকেভিডির হাতে, যে সংস্থার পরে নাম হয় ‘কেজিবি’।

একটি পান-আসর থেকে ফেরার পরে হঠাৎ করে গোর্কিপুত্র পেশকভের মৃত্যু হয়। গুলাগের বিরোধিতা করার জন্যই পুত্রের মৃত্যু হয়েছে তা গোর্কি বুঝতে পারেন।তিনি এও বুঝতে পারেন রাশিয়ার গুপ্ত পুলিশ এনকেভিডি’র এজেন্টরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আর এই ঘটনার পর থেকেই গোর্কি-স্তালিন সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। গোর্কি নিজেও ‘গুলাগ’এর বিরোধিতা করে লেখেন- “গুলাগ দ্বীপমালা”। যার সমালোচনা শুরু হয় সরকারি পর্যায় থেকে।গোর্কি চারপাশের অন্যায়, দুর্দশা আর দুর্নীতি দেখে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে গুলি করেছিলেন নিজের বুকে কিন্তু ভাগ্যের জোরে সেযাত্রা বেঁচে যান।

বাবা-মায়ের মৃত্যু, অনাহার, অবহেলা, ছেড়া ময়লা জামাকাপড়, মনিবের প্রহার,রূঢ় ব্যবহার, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ‘আলেক্সেই পেশকভ’কে ধীরেধীরে ম্যাক্সিম গোর্কি’ করে তুলেছিল। কাজানে গোর্কি ছিলেন অনেকদিন। সেখানে তাঁর আশ্রয় ছিল পুরনো ভাঙ্গা একটি বাগানবাড়ি। সেখানে গণিকা, জেলফেরত কয়েদী, ক্ষয়রোগী, বিপ্লবী থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের ছাত্ররাও থাকত। তাঁদের জীবনযাপন, পরবর্তীদিনে গোর্কির সাহিত্যে আখ্যান হয়ে ধরা দেয়। শাসকশ্রেণীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরূদ্ধে সবসময়ই সরব ছিলেন গোর্কি। এজন্য জেলবন্দীও হয়েছেন বহুবার। মার্ক্স পড়ে মুগ্ধ হন গোর্কি। আলাপ হয় লেনিনের সঙ্গে। সারা রাশিয়া উত্তাল হলে প্রতিবাদে যোগ দিলেন লিও তলস্তয়, লেনিনের মতো দিকপালেরা। এরই মধ্যে গোর্কি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পাঠানো হয় ক্রিমিয়ায়। জারের অত্যাচারে একসময় আমেরিকায় পাড়ি জমাতে বাধ্য হন গোর্কি। সেখানেই রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদার’, যার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন বিপ্লব ছাড়া শোষিত শ্রেণীর মুক্তি কখনোই সম্ভব নয়। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর রাশিয়া জুড়ে যখন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হল, বিভিন্ন পত্রিকার ওপর সেন্সর আরোপ শুরু হল তখন কমিউনিস্ট পার্টির কিছু নেতার সঙ্গে গোর্কির মতবিরোধ শুরু হয়। লেনিন সব বুঝে গোর্কিকে নির্বাসনে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এদিকে ১৯৩২ সালে লেনিন মারা যাওয়ার পর স্তালিনের আমন্ত্রণে নির্বাসিত জীবন থেকে রাশিয়া ফিরলেন গোর্কি। স্তালিন মস্কোতে তাঁকে থাকার জন্য প্রাসাদোপম একটি বাড়ি দিলেন, উপযুক্ত সম্মান দিলেন কিন্তু জীবনের শেষ দিকে রাজনৈতিক কারণে স্তালিন গোর্কিকে হাউজ অ্যারেস্ট করেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version