পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের দুই নম্বর ব্লকে জঙ্গল ঘেরা একটি ছোট্ট গ্রাম লবনধার। আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি গাছ। শাল সেগুন মহুয়া সহ আরও বহু ধরণের গাছ। অন্তত ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত সেই ঘন জঙ্গল। গাছে গাছে নানা রকম পাখির কিচিরমিচির শব্দ। সব মিলিয়ে অরণ্যের নীরব পরিবেশে এক অপার সৌন্দর্য বিরাজ করছে। জঙ্গলের মাঝে গড়ে উঠেছে আদিবাসী অধ্যুষিত জনবসতি। এরকমই এক জনবসতি হলো দেবশালা অঞ্চলের ‘বড়ডোবা’ মৌজার লবনধার গ্রাম।  

প্রায় তিনশ বছর আগের ঘটনা। পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রামের ঘন জঙ্গলের গা ছম ছম করা পরিবেশে দেবশালা অঞ্চলের বিখ্যাত ‘বড়ডোবা’-র তীরে ছিল এক বিশাল বটগাছ। শোনা যায় কোনো একসময় একটি পায়রা অথবা চিল সেই গাছের উপর এসে বসে। তখন ওই ডোবাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি আদিবাসী পাড়া। তবে শুধু আদিবাসী নয় অন্য জাতের মানুষও আছে অনেক।এই গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে শুধু জঙ্গল প্রেমীরা নয় সাধারণ মানুষও ছুটে আসেন। শীতের সময় তাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। কেউ আসেন পিকনিক করতে, কেউ শুধুমাত্র সৌন্দর্যের টানে।

লোকের মুখে মুখে এই গ্রাম আবার ‘আল্পনা’ গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে এই নাম কে বা কারা দিয়েছেন সেকথা গ্রামবাসীদের কাছে অজানা থেকে গিয়েছে। তবে যুগ যুগ ধরে এই গ্রামের আদিবাসী রমণীদের সৌন্দর্যের প্রতি একটা আলাদা ভালবাসা রয়েছে। শত দুঃখ-কষ্ট বা অভাবের মধ্যেও যা তাঁরা কোনোদিনও ভোলেননি। তাঁরা নিজেরা যেমন সাজতে ভালবাসেন তেমনি তাঁদের গৃহস্থালির মধ্যেও সেই সৌন্দর্য ধরা পড়ে। চর্যাপদের যুগ থেকে শুরু করে এই আধুনিক যুগেও তারা সেই ধারা বজায় রেখেছে। লবনধার গ্রামের প্রায় প্রতিটি আদিবাসী বাড়িতে সেই চিহ্ন ধরা পড়ে। মনসা মন্দিরে যেমন আছে সাপের চিত্র, তেমনি কোথাও আছে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। পশুপাখি, মাছ ইত্যাদি তো আছেই।

উল্লেখ্য, দেবশালা পঞ্চায়েতের লবণধার গ্রামের গাছপালা বাঁচাতেই গ্রামেরই কয়েকজন যুবক সংগঠন তৈরি করে প্রথমে সাধারণ মানুষদের মধ্যে বনসৃজন, জঙ্গল সংরক্ষণের প্রচার শুরু করেন। কিন্তু তাতে তেমন সাড়া পাননি। এরপর প্রকৃতিকে বাঁচাতে তাঁরা গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ির দেওয়ালে জঙ্গল সংরক্ষণ নিয়ে নানান ছবি এঁকে প্রচার শুরু করেন। এই উদ্যোগ গ্রামের মানুষের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য হয়। এরপর এগিয়ে আসেন গোটা গ্রামের মানুষই, তাঁরা সকলেই নিজেদের বাড়ির দেওয়ালে অঙ্কনের স্বেচ্ছায় অনুমতি দেন।  দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি এঁকে প্রচার শুরু হয়। কিছুদিনের সেই প্রচেষ্টায় তাঁরা প্রায় অধিকাংশ গ্রামের দেওয়ালে নানান ছবি এঁকে ফেলেন। সেই ছবিতে ধরা আছে জঙ্গলের পরিবেশ, আদিবাসী সমাজের পরিবেশ, তাঁদের সংস্কৃতি । কোথাও পৌরাণিক কাহিনী, দেবদেবীর কথা। আর এভাবে সেজে উঠেছে গোটা গ্রাম।

শুধু তাই নয়, স্হানীয় মানুষদের ছেলে মেয়েদেরকে সাংস্কৃতিক মনস্ক করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্হাটি আরও একটি উদ্যোগ নেয়। গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গ্রাম বাংলায় দেওয়াল চিত্রের ছবি একেবারেই নতুন নয়। এখনো পর্যন্ত বহু জায়গায় মাটির বাড়ি সাজানো হয় আলপনা দিয়ে। এক্ষেত্রে যে সমস্ত রং ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগটাই প্রাকৃতিক। বর্তমানে যদিও বাজারে নানান রঙের রমরমা। কিন্তু একটা সময় সমস্ত রং গ্রামের ছেলেমেয়েরা নিজের হাতে তৈরি করতেন। যেমন খড়ি মাটি ভিজিয়ে তৈরি করা হত লাল রং, আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে সাদা রং। এছাড়াও আলপনা আঁকার রং তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় হতো শুকনো বরই, আমের আঁটির শাঁস চূর্ন, গিরিমাটি, মান কচু ও কলা গাছের আঠার সঙ্গে নানান রঙের মিশ্রণ

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version