অবশেষে বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের বিদায়। বিজেপি সরকারের মনোনীত উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী তিনি। তাই তিনি আর বাংলার রাজ্যপাল নন। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দৌড়ে তাঁকে সামিল হতে বলামাত্র তিনি রবিবার রাতেই ইস্তফা দেন এবং রাষ্ট্রপতি তাঁর ইস্তফা গ্রহণ করেন। সোমবারই উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে রবিবার রাতেই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে বাংলার অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে আপাতত কাজ করবেন মণিপুরের রাজ্যপাল লা গণেশন ( LaGaneshan )। মনিপুরের পাশাপাশি তিনি বাংলার দায়িত্বও সামলাবেন।

উল্লেখ্য, বাংলার রাজ্যপাল পদে কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই জগদীপ ধনখড় ওই পদে আসীন হন। কেন্দ্রের বিজেপি তাঁকে বাংলার রাজ্যপাল করে পাঠিয়েছিলেন যাতে বাংলার অবিজেপি সরকারকে তিনি প্রতি মুহুর্তে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পারেন। বলা বাহুল্য যে ধনখড় কেন্দ্রের সেই আশা সফল করতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বিজেপির মুখপাত্র হিসাবে প্রায়শই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা সরকার ও শাসক দলকে নানা ভাবেই আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন। রাজ্যের বিভিন্ন আমলা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের হুমকি ধমকি দিয়েছেন। রাজ্য সরকারের বিল আটকেছেন, জবাবদিহি চেয়েছেন। আর প্রতিদিনই মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য সরকারের কাজের সমালোচনা করে চালিয়েছেন টুইট বন্যা। তাঁর আমলে বাংলার রাজভবন কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির পার্টি অফিস। কিন্তু এতসব কর্মকাণ্ডের পরও ধনকড় একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে জেতাতে পারেননি। 

তবে একথাও ঠিক যে মমতা-ধনখড় এতসব দ্বন্দ্বের মধ্যেও তাঁরা সৌজন্যতা রক্ষা করতে মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। জগদীপ ধনখড়কে সস্ত্রীক দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির পুজোয়। যাই হোক বাংলার প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় আপাতত বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়ি টেনে উপরাষ্ট্রপতির দৌড়ে সামিল হয়েছেন। এখন প্রশ্ন কে এই লা গণেশন (LaGaneshan), কেন মোদি সরকার বাংলায় স্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে কাউকে নিয়োগ না করে মণিপুরের রাজ্যপালকে আপাতত বঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব দিল? এটা ঘটনা যে ধনখড় যে কাজ শুরু করেছিলেন সেই কাজ যাতে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্যই বিকল্প ভাবনা। কিন্তু সেই বিকল্প চট জলদিনা মেলায় আপাতত লা গণেশন-কেই বাংলার অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে মোদি সরকার নিয়োগ করেছে।

আপাতত বাংলার রাজ্যপালের দায়িত্ব যাঁকে দেওয়া হল সেই তামিলনাড়ুর ব্রাহ্মণ পরিবারে সন্তান লা গণেশন জীবন শুরু করেছিলেন আরএসএস সদস্য হয়ে। তামিলনাড়ু বিজেপির শীর্ষ নেতা ছিলেন। পরে রাজ্যপাল হন। তারপর ধাপে ধাপে উত্থান। সংঘ ঘনিষ্ঠ পরিবারের এই সদস্যটিকে অনেকেই বাড়ির ছেলে বলেও ডাকেন। গনেশন অবিবাহিত থেকে আরএসএস প্রচারক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেনছিলেন। নিয়মানুসারে সংঘের প্রচারকরা বিয়ে করতে পারে না। গণেশনও এই নিয়ম মেনে বিয়ে করেননি। তবে সঙ্ঘের নির্দেশেই তিনি রাজনীতিতে আসেন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময়তাঁর হলফনামা থেকে জানাযায়, তিনি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

গনেশন গত শতকের সত্তরের দশকের জরুরি অবস্থার সময় আরএসএসের (RSS) প্রচারক ছিলেন। এই পদে তিনি ছিলেন এক বছর। বিজেপি এরপর তাঁকে জাতীয় সম্পাদক করে। এরপর লা গণেশকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করা হয়েছিল। এমনকি তামিলনাড়ু বিজেপির রাজ্য সভাপতিও করা হয়। ২০১৬সালেতিনি মধ্যপ্রদেশ থেকে বিজেপির হয়ে রাজ্যসভার সদস্য হন। নাজমা হেপতুল্লা তার স্থলাভিষিক্ত হন এরপর ২০২১ সালে তিনি মণিপুরের রাজ্যপাল হন। এবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেলেন। বিগত তিন বছর ধরে বাংলার রাজ্যপাল বনাম শাসকদলের বাগ্‌যুদ্ধে সরগরম ছিল রাজনীতির ময়দান।তবে এটা লক্ষ্য করা গিয়েছে, এরাজ্যের রাজ্যপালদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সব দলেরই অভিযোগ, রাজ্যপাল হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট। তাঁদের একমাত্র কাজ হলো, সেই দলের বা কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জিমতো চলা।

বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে নিয়েও গোড়া থেকে বিতর্কের অন্ত ছিল না। আগেও ১৯৬৭ সালে রাজ্যে তখন প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার হয়; বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস ও সিপিআই এবং সিপিএম জোট মিলে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সেই সরকার বছর খানেকও টেকেনি। বিল্পবী বাংলা কংগ্রেসের কিছু বিধায়ক মিলে কংগ্রেসের সঙ্গে সরকার গড়তে চাইলেন। জ্যোতি বসু বললেন, বিধানসভায় শক্তিপরীক্ষা হোক। তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীর সেই দাবি না মেনে নতুন সরকারকে শপথে ডেকে নিলেন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন কেন্দ্রে ও রাজ্যে কংগ্রেস। ফলে রাজ্যপালের সঙ্গে বিরোধ হওয়ার কথা নয়, হয়ওনি। জ্যোতি বসুর দীর্ঘ মুখ্যমন্ত্রিত্ব কালে রাজ্যপাল ছিলেন এ পি শর্মা। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের সুপারিশ না মেনে উপাচার্য করেছিলেন সন্তোষ ভট্টাচার্যকে। তাই নিয়ে দীর্ঘদিন সরকার বনাম রাজ্যপাল সংঘাত হয়েছে। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল করে পাঠান প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান টিভি রাজেশ্বরকে। তখনও সংঘাত বেঁধেছে। রাজীব ক্ষমতা হারানোর পরে রাজেশ্বরকে বিদায় নিতে হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর নাতি গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী রাজ্যপাল থাকাকালীনও বার বার রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর সংঘাত ঘটেছে। নন্দীগ্রামের ঘটনা নিয়ে একাধিকবার কড়া সমালোচনা করেছেন গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী, যা মানতে পারেনি রাজ্য সরকার ও সিপিএম।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনজন রাজ্যপাল পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। এম কে নারায়ণন, কেসরী নাথ ত্রিপাঠী এবং জগদীপ ধনখড়। তিনজনই সরকারের সঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। তবে ধনখড়ের সময় বিরোধ যেন সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এবার দেখার নতুন রাজ্যপাল লা গণেশনের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কী রকম হয়।
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version