ছবির টানেই বাড়ি থেকে পালিয়ে কার্গিলে

মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ছোট থেকে ফটো তোলার শখ। বরাবরের নিজের সম্পর্কে কিছু বলায় অনীহা। তার থেকে শহর বা গণ্ড গাঁয়ের কোনো ঝড় ঝঞ্ঝা বিধস্ত এলাকায় দিনের পর দিন পরে থেকে ক্যামেরার সাটার টিপে যাওয়ায় অক্লান্ত।
বেণু সেনের কাছে হাতেখড়ি। এক প্রদর্শনীতে গালফ যুদ্ধের কিছু ছবি নাড়া দেয় মনে। উঁকি মারে যুদ্ধের ছবি তোলার বাসনা। এরইমধ্যে কার্গিলে শুরু হলো গোলমাল। দিল্লিতে খেলার ছবি তোলার কথা বাড়িতে বলে সোজা জম্মু। তারপর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কার্গিল-দ্রাস-বাতালিক। সেই যুদ্ধ নিয়ে বই লিখতে গিয়ে তার ছবি ব্যাবহার করেছেন প্রাক্তন সেনা প্রধান শঙ্কর রায়চৌধুরী। সেই কার্গিল যুদ্ধের তোলা ছবি তাকে দিয়েছে রাষ্ট্রপতি সন্মান। সেই পিয়াল অধিকারী -কে ২৬ জুলাইয়ের আগের দিন পড়ন্ত বিকেলে অবশেষে তাকে ধরা গেল তাঁর কাঁচড়াপাড়ার বাড়িতে। বাড়ির ছাদে তাঁর দু’দশক আগের সেই স্মৃতি মুঠোফোনে বন্দি করলেন অমিতাভ ত্রিবেদী

শ্রীনগরে সেনা ব্যারাকের বারান্দায় রাত কাটানো। প্রায় হাতে পায়ে ধরে কোনওভাবে শোনমার্গ। মেজরের কড়া চোখের সামনে তখন তিনি যেন এক ভেকধারী জঙ্গি। আবার তাঁকেই ছবি তোলার কিছু কারিকুরি শিখিয়ে মন জয়ের চেষ্টা। মেজর হাতে তুলে দিলেন এক রিভলভার। বললেন, চালাও গোলি। আসলে সেটাও ছিল এক পরীক্ষা। রিভলভারে কোনও গুলি অবশ্য ছিল না একে একে সব বাধা ডিঙিয়ে লক্ষ্যের কাছাকাছি। বোফোর্স থেকে পাক ঘাঁটি লক্ষ্য করে ভারতীয় সেনার গোলা বৃষ্টি। ওপার থেকে ছুটে আসা মর্টার সেল কানের পাস দিয়ে গিয়ে লক্ষভ্রষ্ট হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া……

জেরার পর জেরা। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। নানা ভাবে পরীক্ষা। ছবি তোলার অছিলায় অন্য কেউ নয় তো! রাতে দুই মেজর আর ল্যাব্রাডর নিয়ে দুর্গম স্থানে নিয়ে যাওয়া হল। প্রাণে মেরে ফেলবে নাকি! প্রায় কেঁদে ফেলে প্রাণ ভিক্ষা। অবশেষে সে রাতেই প্রথম পরীক্ষায় পাশ। রাতেই সাত শহীদ জওয়ানের দেহের ছবি তুলে শুরু হলো যুদ্ধের ছবি তোলা। রাতে আবার আশঙ্কা। কাল ফিরিয়ে দেবে না তো শ্রীনগর! অবশেষে সকালেই সেনার পোশাকে সোজা মাটাইন সেক্টর।

মাইনাস কুড়ি থেকে তিরিশ ডিগ্রি ঠান্ডায় যুদ্ধ করছেন জওয়ানরা। হ্যাঁ। দ্রাসে প্রায় ১০ দিন সেনাদের সঙ্গে দিন-রাত। ছবি তুলতেও আরেক ভাবনা। সঙ্গে মাত্র পনেরোটা রিল। তার মধ্যেই সাটার টেপা। সেখানকার তোলা ছবিই ২০১৭ সালে এনে দেয় রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। সেখান থেকে অবশেষে অন্তিম অভিষ্ট। কার্গিল। এক প্রায় কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে এমন ছবি তোলার নেশায় যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছাতে দেখে হোটেল মালিক ছেড়ে দিলেন নিজের ঘরটাই। একেবারে মুফতে। তারপর যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া মানুষের কাছে যাওয়া। তাঁদের জীবন নিয়ে ছবি-লেখা। আদপে জীবন নিয়ে শেষ পর্যন্ত শোনমার্গ ফেরায় সেই মেজর গিল দিলেন পার্টি। নিজেই গাড়ি নিয়ে পৌঁছে দিলেন শ্রীনগর। লক্ষ্য আর ইচ্ছে শক্তি এক শখের ফোটোগ্রাফারকে করে দিল সেলিব্রিটি। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠলো মুখে।

আজ কার্গিল দিবসে সেই বীর সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ আমাদের। আর রণাঙ্গনে সেই সব বীর জওয়ানদের কামান, রকেট লঞ্চার আর বন্দুকের নলের ছোড়া গুলির মতোই সমানে পাল্লা দিয়ে গিয়েছেন এক যুবক। নিজের ‘অস্ত্রে’ সাটার টিপে সেইসব সেনানীদের কথা ছবিতে তুলে ধরায় এমন অনেক ছবি পৃথিবী দেখেছে, যা হয়তো পাওয়াই যেত না তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে, কাঁচড়াপাড়া থেকে কার্গিল পৌঁছে না গেলে।।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version