ছেলেটি এত ভাল ফুটবল খেলেযেবিভিন্ন ক্লাব তাঁকে জেতার জন্য ভাড়া করে খেলাতে নিয়ে যেত। খেলায় ওই ছেলেটিরজন্যেই ম্যাচ জিততো সেই ক্লাব আর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেত ওই ছেলেটি। একবার তো পুরস্কার বিতরণ করতে এসে গোষ্ঠ পাল ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,“আচ্ছা খোকা বলো তো আসলে তুমি কোন ক্লাবের মেম্বার? আমার যতদূর মনে পড়ছে আজ নিয়ে এই বছরে অন্তত চারবার তোমাকে মেডেল দিলাম চারটে বিভিন্ন ক্লাবের সেরা ফুটবলার হিসেবে’! চ্যাম্পিয়ন ক্লাব কতৃপক্ষ আর তাঁর বন্ধুরা তখন ধরেই নিয়েছিলেন যে ছেলেটি বড় হয়ে ময়দানের কোনও বড় দলের হয়ে খেলবেন। ছেলেটিও স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে কলকাতার বড় ক্লাবের খেলোয়াড় হবেন। বাবাকে লুকিয়ে খেলতে গিয়ে পুরস্কার জিতে বাড়ি ফিরেও বাবার হাতে মার খেয়েছেন অনেক বার। শেষ পর্যন্ত আর বড় ক্লাবের হয়ে খেলা হয়নি।

কারণ ছেলেটি হটাতই মনযোগী হয়ে গেল অভিনয়ে। ছেলেবেলায় অভিনয় করে প্রশংসা পেয়ে তাঁর নাটক করার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠল। পাড়ার মাঠে স্টেজ তৈরি করে বন্ধুদের সঙ্গে চলতে লাগল বিভিন্ন রকম নাটকের অভিনয়। ফলে ভাল খেলোয়াড়ের খেলাটা পড়ল পিছিয়ে প্রাধান্য পেল অভিনয়। কেবল অভিনয় নয়, যৌবনে পা দিয়ে ‘ঝর্ণা’ নামে হাতে লেখা পত্রিকার জন্য কবিতা লিখলেন, “আম পাকে জাম পাকে দাদা তুমি কেন পাকো না?”সেই কবিতার লাইন ব্যঙ্গোক্তি হয়ে বন্ধুদের মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু একদিন ফুটবল, নাটক কবিতা সবই ছেড়ে দিলেন তিনি।

তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে অস্থিরতা। এক বন্ধুর পরামর্শে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। তার আগে ট্রেনিং নিতে কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন পঞ্জাব। সেখানেও বেশি দিন থাকা হল না।তাঁর বাবা বহু চেষ্টা করে ফিরিয়ে আনলেন ছেলেকে। ফুটবল, নাটক কবিতার স্বপ্ন ভেঙে গেল ভেঙে। চারপাশের অনিশ্চয়তায় পেরে না উঠে ফের কলকাতা ছাড়লেন। এবার দিল্লি, ওয়ারলেস হেড কোয়াটার্স স্বপ্ন এয়ারফোর্সে যোগ দিয়ে আকাশে উড়বেন। তখন সারা ভারতের মতো দিল্লির রাজপথও ১৯৪২-এর আন্দোলনে উত্তাল। বহু সাধারণ মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে ঢুকছে। মন সায় দিল না, যখন ইংরেজের বিরুদ্ধতা করে এতগুলো মানুষ মরছে,  তখন তাদের থেকে যুদ্ধের ট্রেনিং নেবেন কিভাবে? অতএব ফিরে এলেন কলকাতায়। একদিন হিরন্ময় সেন-এর ‘বার্মার পথে’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে জেদের বশে রাজি হয়ে গেলেন। একে একে কাজ করলেন ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘পদ্মাপ্রমত্তা নদী’, ‘অ্যায়সা কিঁউ’ ও ‘বিশ রোজ কে বাদ’, ‘তথাপি’ ইত্যাদি ছবিতে।

ছবির অভিনয়ে মন ভরছিল না তাই শ্রীরঙ্গমে শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করলেন। মহলায় হাজির থাকায় ‘তাইতো’, ‘সাজাহান’ নাটকে অভিনয় করারসুযোগ ঘটে। সেটা বন্ধ হলে নিজেরাই দল বানিয়ে নাটক শুরু করলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে ‘কেদার রায়’ নাটকে কার্ভালো চরিত্রে অভিনয়ের খ্যাতিতেই মহেন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে আলাপ এবং তাঁর পরিচালনায় ‘শতবর্ষ আগে’, এর পর ‘টিপু সুলতান’, ‘স্বর্গ হতে বড়’ নাটকে কাজ করেন। এর পরই একদিন স্টারে অভিনয় করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ‘রশিদ আলি দিবস’-এর মিটিং দেখে সব ভুলে নেমে পড়লেন বাস থেকে। মিশে গেলেন অগণিত জনতার মিছিলে। নাটক করতে আর যাওয়া হল না। নাটক থেকে বাদ পড়ল তাঁর নাম। ১৯৪৬ সালেও কলকাতারদাঙ্গা থামাতে অনেকের মতো তিনিও রাস্তায় নেমেছিলেন।

এরপর অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ছবিতে অভিনয়ের সময় আলাপ হল জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। সেই সূত্রেই যোগ দিলেন আই পি টি এ-তে।দু’বছরের মধ্যে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে স্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পার্টির কাছেতাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন জ্যোতি বসু।পাশাপাশি নিজের পরিচালনায় সলিল চৌধুরীর লেখা ‘শান্তি চাই’,  রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তির উপায়’, একে একে ‘নয়ানপুর’, ‘সংকেত’, ‘ভাঙাবন্দর’, ‘বিসর্জন’ ‘দলিল’ নাটকে অভিনয় করেন। কিন্তু গণনাট্যর কর্মকাণ্ডেও একটা সময় অসুবিধে হচ্ছিল। নানা ধরণের সংকটে জটিলতা তৈরি হচ্ছিল। আন্দোলনের কিছু অভিজ্ঞতা থেকেও প্রশ্ন উঠছিল। এই সময় বন্ধু মনোরঞ্জন ঘোষের ‘বরযাত্রী’ ছবিতে গনশা চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে গেলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশাদার অভিনেতা হিসেবে নিয়মিত অভিনয় শুরু করে ডাক পেলেন তপন সিংহ-র প্রথম ছবি ‘অঙ্কুশ’, তার পর ‘টনসিল’, বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’ ছবিতে। অভিনয় করেন সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিকের ছবিতে।  ‘অযান্ত্রিক’, ‘কত অজানারে’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘লৌহকপাট’, ‘ডাকহরকরা’, ‘পরশপাথর’ ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।

অন্য দিকে পেশাদার মঞ্চে ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকে শশী কম্পাউন্ডার ও ‘ক্ষুধা’ নাটকে সদার চরিত্রে তাঁর অভিনয় মিথ হয়ে আছে। মুম্বতেও কাজ করেছেন নবেন্দু ঘোষের ‘ডগদরবাবু’, হৃষীকেশ মুখ্যোপাধ্যায়ের ‘বাবর্চি’, ‘সব সে বড়া সুখ’। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টেকেনি। সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শো ছবিতে কাজ করেছেন। নাটক করেছেন একত্রিশটি।কিন্তু কোনও স্বীকৃতিই সেভাবে পাননি এই অভিনয় শিল্পী। ২০ নভেম্বর তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। পুরো নাম কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Share.

1 Comment

  1. tarun majumdar on

    আমাদের দেশে প্রকৃত কোনো শিল্পী কোনো দিন কি কোনো স্বীকৃতি পেয়েছেন।

Leave A Reply

Exit mobile version