অপূর্ব মিত্র

শেষ পর্ব

জোংরি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা —
জোংরি টপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করে এবার ওখান থেকে বিদায়ের পালা। আশপাশের প্রকৃতির উপরেও ততক্ষনে নতুন দিনের আলো। হাঁ হয়ে চারদিক গিলতে লাগলাম, কিন্তু কিছুতেই আশ মেটে না। মনে হয়, আরো কিছুক্ষন থেকে যাই। কিন্তু গাইডের কড়া নির্দেশ আমাদের এবার ফিরতেই হবে। দূর থেকে দেখলাম এক পাহাড়ি নদী। থানসিং, সমিতি, চেমাথাং হয়ে ওই নদী পাশে রেখেই গোয়েচা-লা যাবার রাস্তা। আমরা ওই পথে এগোব না। এবার ফিরব, ওই বোল্ডার ঝরা পাহাড়ের পাশ দিয়ে। গোমুখ পেরিয়ে নন্দনকানন যাবার পথে এই ধরনের পাহাড়ে পথ চলার অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছিল। যাইহোক, সেই রাস্তা খুব সাবধানে পাড়ি দিয়ে আমরা যখন ট্রেকার্স হাটে পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে প্রায় ন’টা।
এসে দেখি এরই মধ্যে মধ্যে পোর্টাররা তাদের নিজেদের জন্য রান্না চাপিয়ে দিয়েছিল। আমরা রেশন চেক করে দেখেছিলাম, যা রেশন রয়েছে তাতে আমাদের বড় জোর একদিন চলতে পারে। সুতরাং এযাত্রায় গোয়েচা-লা যাওয়া আর কোনো মতেই সম্ভব ছিল না। ট্রেকিং সাঙ্গ করে এবার ফেরার পালা। আমরা আর সময় নষ্ট না করে, কিছু না খেয়েই মালপত্র গুছিয়ে বাখিমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নীচে নামবার সময় মনে হচ্ছিলো এই এত অল্প দুরত্বে এত কম সময়ে ও কম পরিশ্রমে এত বৈচিত্র্য আর কোথাও গেলে পাওয়া যাবে কিনা! আমার অন্তত জানা নেই। বাখিম বা সোকা পর্য্যন্ত পর্ণমোচী বৃক্ষের সাথে সাথে শাল, সেগুন, মেহগনি, আম, জাম, কাঁঠাল ও চোখে পড়েছে। এমন সহাবস্থান বেশ অবাক লাগে। আর যেই আমরা সোকা ছাড়িয়ে আরো উপরে উঠছিলাম, তখন ভূমির গঠন আর বৃক্ষের বৈচিত্র্য স্বতন্ত্র হয়ে দেখা দিল। সেখানে তৃণভূমি, আর কুসুমিত রডোডেনড্রনের ঘন জঙ্গল। আবার জোংরির আশেপাশে কোনো বৃক্ষ বা তৃনরাজি নেই বললেই চলে। মাটি বলতে ছাই জাতীয় ঝুরো মাটি। পথের পাঠ রিভিশন করে নিতে নিতে বাখিম পৌঁছাতে প্রায় তিন’টে বাজল। কিন্তু তখনও আমাদের ইয়াক পার্টির দেখা নেই। প্রশংসা পেয়ে সংযম হারিয়ে কোথাও ঘাস চিবাচ্ছে কিনা বলতে পারবো না। এদিকে পেটে ছুঁচোর ডন দিচ্ছে। সর্বগ্রাসী খিদে, কিন্তু এক কণাও খাবার নেই। এমন অবস্থায় হাত পাতা ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। একটা ট্রেকিং পার্টিকে আসতে দেখা গেল। আর দলটা বাঙালিদেরই। কোনরকম চক্ষু লজ্জা না করেই ক্যাপ্টেন সমীর ওদের কাছে গিয়ে ছাতুর আবেদন পেশ করল। তারাও নির্দ্বিধায় দিয়ে দিল। আর তার জন্য কোন কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তাও পরেনি। একটা থালার মধ্যে ওদের দেওয়া প্রায় এক কেজি ছাতু মাখা হ’ল। আর আমরা সবাই সেই থালার চারপাশে গোল হয়ে বসে মুহূর্তের মধ্যে সব সাবাড় করে দিলাম। এরমধ্যে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। তখন রাত সাতটা হবে। বৃষ্টির শব্দ চিরে টুং টাং আওয়াজ জানান দিল আমাদের ইয়াক দুটি অবশেষে পৌঁছেছে। ছাতু খাবার পর আমাদের কোনো কাজ ছিলোনা, কিন্তু ফজল আছে। ফজল খিদের জ্বালা একদম সহ্য করতে পারে না। সুতরাং এই সময় ওর পিছনে লাগার দানবীয় ইচ্ছা জেগে উঠল। ফজল মাটিতে বসে রান্নার ব্যবস্থা করছে আর আমরা বিছানায় বসে বসে ওকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করতে লাগলাম। ফজল গুম হয়ে বসে আছে। স্টোভ জ্বালিয়ে, চাল ডাল যা ছিল সব নিয়ে খিচুড়ি বসিয়েছে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। পাত্র ছোটো হওয়ায় একবার কিছুটা এ পাত্রে আর কিছুটা অন্য পাত্রে ঢেলে ঢেলে মেশাচ্ছিল। আমরা একমনে এক সঙ্গে চার জোড়া চোখে সব লক্ষ্য রাখছিলাম আর কেমিস্ট্রিটা বোঝার জন্য মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেই রাতে ফজল সবাইকে খেতে দিলো বটে কিন্তু ওর নিজের আর খাওয়া হল না।

ফেরার পালা —

বাখিমের ট্রেকার্স হাটটা বেশ সুন্দর। সেই সময় জোংরি ছাড়া বাকি সমস্ত ট্রেকর্স হাটেই কিন্তু বিজলি বাতির সুবন্দোবস্ত ছিল। রাতটা কাটিয়ে সকাল হতেই বাখিম ছেড়েছি ইয়কসামের উদ্দেশ্যে। দশটার মধ্যেই নেমে এলাম ইয়কসাম। সেখানে কিছু খাবার পর আবার সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম জোড়থাং-এর উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার নেমে এল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা নো-ষ্টার হোটেল বেছে নিয়ে উঠলাম। ইয়কসাম থেকে আসার পথে দিন দুয়েকের চাল ডাল কিনে নিয়েছি। রোজ খিচুড়ি খেয়ে জিভ বোধহয় সব স্বাদ ভুলে গেছে। তা ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ উপরে সব্জী অমিল। আর আমরাও রন্ধন শিল্পে পটু নই। আর ওই খিচুড়ী তৈরী হতে ঘন্টা দুই বরাদ্দ ছিল। আজ বেশ আনন্দ। মেনু বদলেছে। একটা স্টোভে ভাত আর আলু সিদ্ধ বসেছে, আর একটায় ডাল চেপেছে। এ দিকে হয়েছে , ওই হোটেলেই আমাদের পাশের ঘরে আরো দুই বাঙালীর আবির্ভাব ঘটেছে। সুতরাং আলাপ জমাতে চলে গেলাম। কথায় কথায় জানা গেল ছেলে দুটি ফ্রিজ মেকানিক, আর বাড়ি বাগনানে। ঘটনাচক্রে ফজলের বাড়িও বাগনানে। ফজল দেখি আবার চুপ করে গেছে। আমার বুঝতে একটু সময় লাগল। ওরা খাবার জন্য দুই প্লেট মাংসের অর্ডার দিয়ে সুরা পানের বন্দোবস্ত করছিল। আমাদের রান্নাও ধীরে লয়ে এগিয়ে চলেছে। দেশওয়ালিদের কারবার দেখে ফজল কিছুতেই বিষয়টা হজম করতে পারছিল না। এদিকে সস্তায় পাওয়া সুরা আকন্ঠ পান করে চলেছে ছেলে দুটি। অবিলম্বে বেহেড অবস্থা। অতিরিক্ত পানে যেমন হয় আর কি। যাই হোক, যখন দুই প্লেট অর্ডারি মাংস এসে পৌঁছাল ততক্ষণে ওরা বেহুঁশ অবস্থায় মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, আর আমরাও কর্তব্যের খাতিরে সেই মাংসের অপচয় করলাম না। ফজলও কিন্তু আর আগের রাতের ভুল করেনি। শেষ পর্যন্ত্য ভাত, ডাল আর আলু চোখা দিয়ে তৃপ্তি করে নৈশাহার সেরেছিল।

আবার ঘরের পথ —–

পরের দিন সকালে উঠে ওরা ওদের নিজেদের কাজের জন্য খুবই অনুতপ্ত ছিল, আর আমরাও নিজগুণে ক্ষমা করে দিলাম। এবার জোড়থাং থেকে শিলিগুড়ি। নামতে নামতে রাত প্রায় এগারোটা হয়ে গেল। খুব দুশ্চিন্তা রাতটা কোথায় থাকা যায়? এই রাতে মামার বাড়ি হানা দেওয়া ঠিক নয়। চক্ষুলজ্জা বলে একটা শব্দ আছে। কিন্তু কথায় বলে না, “যার কেহ নাই , তুমি আছ তার”। ওরাই প্রস্তাব রাখল, রাতটা ওদের বাসায় থেকে যাবার জন্য । ভদ্রতার খাতিড়ে আমরাও সেই সময় ওদের অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারিনি। মনে পরল, জোড়থাং থেকে ফেরবার সময় কালিঝোড়া বাজার থেকে আমরা নিজেদের জন্য পঞ্চাশ পয়সার মুড়ি আর চপ কিনেছিলাম, ওদের দুইজনকে বাদ দিয়ে। সেই অনুশোচনা মাথায় নিয়ে সেই রাতে ওদের বাসাতেই ডিম সহযোগে গরম ভাতের সেবা নিয়ে ফেললাম। অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই ব’লে আমরা কিচ্ছুটি মনে করিনি। যাই হোক, সেই রাতটা ওদের বাসায় কাটিয়ে পরের দিন রাত্রে কলকাতার বাসে চড়ে বসলাম। কয়েক দিনের অঢেল ভ্রমণে যদিও খুবই ক্লান্ত ছিলাম, তবুও বাসের দুই পুলিশের নিজেদের মধ্যেকার কথা-বার্তা কানে আসছিল। একজন আরেক জনকে খুব দরকারি কথাবার্তা অর্থাৎ বাসের সময়ের হিসাবের সাম্প্রতিকতম খবর জানাচ্ছিল এই বলে যে, “আগে রাত আট’টায় বাস ছাড়তো আর সকাল আট’টায় পৌঁছত, সময় লাগতো দশ ঘন্টা আর এখন রাত দশটায় ছাড়ে আর সকাল দশটায় পৌঁছয় সময় লাগে বারো ঘন্টা”। চাকরি জীবনে ব্যাংকের তহবিলের হিসাব মিলিয়ে এলাম জীবনভোর, কিন্তু শেষ দিন পর্য্যন্ত এই দশ ঘন্টার হিসাবটা অনেক চেষ্টা করেও মেলাতে পারিনি।

শেষ

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version