শীতের বেড়ানো
গৌর শর্মা

‘উশ্রী নদীর ঝর্ণা দেখতে যাব ,দিনটা বড় বিশ্রী’, রবি ঠাকুরের সহজ পাঠের বর্ণনা আনুযায়ী আমাদের দিনটি মোটেই বিশ্রী ছিলনা। বরং ছিল সম্পূর্ন আমাদের অনুকুলে। রোদ ঝলমলে নীল আকাশ, আরামদায়ক শীত গায়ে নিয়ে গোবিন্দপুর মোড়ে জাতীয় সড়ক ২ কে বাঁয়ে রেখে গিরিডি রোড ধরে আমরা যখন উশ্রী নদীর ঝর্ণায় এসে পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে দশটা। গাড়ি থেকে নেমে ফুডবক্স নিয়ে সদলবলে হাঁটতে লগলাম ঝর্ণার শব্দকে আনুসরণ করে।দলবল বলতে, আমার দুই শিল্পী বন্ধু সঞ্জীব দত্ত ও বর্ধমানের অমিত দে। আর আমার স্ত্রী জয়া ও পুত্র মৈনাক।


জঙ্গলের অবগুন্ঠন সামান্য সরতেই আমরা এসে দাঁড়ালাম উন্মত্ত বিশাল এক ঝর্ণার সামনে। প্রায় ৩৯ ফুট উচ্চতার বিস্তীর্ণ চওড়া পাথুরে চাতালে অজস্র চঞ্চল জলরেখা একত্রিত হয়ে অবিরত আছড়ে পড়ছে নিচে। মনে পড়ে, ১৯৭৮ এ দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন পিকনিক করতে এসে এখানেই মেরে ছিলাম জীবনের প্রথম ক্যামেরার সাটার। উশ্রীর সেই সময়কার আদিমতা ও ঝর্ণার গতি এখন খানিকটা ক্ষুন্ন হলেও তার আবেদন এখনো পর্যটকদের যথেষ্ট আকর্ষিত করে।


এবার বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের সন্ধিক্ষনে উস্রিতে আশেপাশের মানুষের ভিড় যথেষ্ট থাকলেও বহিরাগতদের অনুপস্থিতি ছিল লক্ষনীয়। বিশেষ করে ভ্রমন পিপাসু বাঙ্গালী যারা সুদুর কলকাতা থেকে সোয়া তিনশো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভিড় জমাতেন এই নির্জন প্রকৃতির কোলে। তব কি ভ্রমন পিপাসু বাঙ্গালীর ভ্রমনসূচী থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ছোটনাগপুরের উশ্রী নদীর এই ঝর্ণা?!
উশ্রীর কাম পোটার সুন্দর টুরি জানান, বছর দশ – পনেরো আগের এই অঞ্চলের নকশাল কার্য্যকলাপের ভীতি এখনো মুছে ফেলা যায় নি বাঙ্গালির মন থেকে। নকশালরা জন জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসায় পর্যটকদের জন্য উশ্রী পর্যটনকেন্দ্র এখন যথেষ্ট সুরক্ষিত। শুধু স্থানীয় পুলিশই নয়, স্থানীয় গরীব মানুষও এখন উশ্রীর পর্যটকদের নিরাপত্তার একটি বড় অংশীদার। তবে এ বছর করোনা মহামরী বাঙ্গালি পর্যটক না আসার আরো একটি অন্যতম কারন।


ধানবাদ থেকে উস্রির দুরত্ব মাত্র ৫৫ কিলোমিটার । হাওড়া থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ডে ধানবাদ পৌঁছে সেখান থেকে রিজার্ভ গাড়ীতে কোলকাতা উশ্রী একদিনেই ঘুরে আসা যায় । উশ্রীতে থাকার কোন ব্যাবস্থা নেই। ১৩ কিলোমিটার দুরে গিরিডি শহরে ও ধানবাদে বেশ কয়েকটা থাকার হোটেল রয়েছে। খাওয়ার ও পানীয় জল অব্যশই সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন। হাতে আরো এক-দুদিন বেশী থাকলে তোপচাচী ও জৈন তীর্থ ক্ষেত্র পরেশনাথ পাহাড় ঘুরে আসা যায় ।

উশ্রী থেকে গোবিন্দপুর মোড় হয়ে তোপচাচি হ্রদের দুরত্ব ৭৯ কিলোমিটার। দুই নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে খানিকটা এগোলেই তোপচাচি হ্রদের প্রবেশদ্বার। প্রবেশ মূল্য দিয়ে আম, শিরিষ, অশত্থ ও বকুলে ঢাকা খানিকটা পথ পেরোতেই হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠবে একাধিক পাহাড় ও টিলায় ঘেরা শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা তোপচাচি হ্রদ। হ্রদের পাশ দিয়ে রয়েছে মনোরম রাস্তা। তোপচাচির এই প্রাকৃতিক হ্রদ থেকে ঝরিয়া অঞ্চলে জল সরবরাহ করা হয়।


১৯২৪ সালের ১৫ নভেম্বর উরিষ্যা-বিহারের তৎকালীন গভর্নর স্যার হেনরী হুইলার এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। প্রকৃতির টানে ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মহানায়ক উত্তম কুমার এখানে একটি বাড়ী তৈরী করেন।সেখানে তিনি মাঝে মধ্যে অবসর যাপন করতেন। এক সময় বহু বাংলা চলচ্চিত্রের শুটিং স্থল ছিল তোপচাচির এই হ্রদ।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version