সুখেন্দু হীরা। ছবি: প্রতিবেদক।

জঙ্গলমহলের কথা উঠলেই প্রথমে মনে পড়ে ঝাড়গ্রামের কথা। ঝাড়গ্রাম মানেই অরণ্য। অতীতে জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলের নাম ছিল ঝাড়িখন্ড। তখন এই অঞ্চল শাসন করত ‘মাল’ বংশ। সর্বেশ্বর চৌহান নামে একজন যুদ্ধ ব্যবসায়ী এদের পরাজিত করে মল্লদেব উপাধি গ্রহণ করে রাজত্ব শুরু করেন। রাজধানী স্থাপন করেন ঝাড়গ্রামে। আধুনিক ঝাড়গ্রাম জেলার জন্ম ৪ এপ্রিল, ২০১৭। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমা নিয়ে এই জেলা গঠিত হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের ২২ তম জেলা। বর্তমানে এখানে আছে নয়টি থানা। ঝাড়গ্রাম থানার উত্তর দিকে লালগড়, বিনপুর, বেলপাহাড়ী থানাগুলি আর দক্ষিণের থানাগুলি হল সাঁকরাইল, বেলিয়াবেড়া, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম। জামবনি থানা হল ঝাড়গ্রামের পশ্চিমে। সর্বমোট আয়তন ৩০৩৭.৬৪ বর্গ কিলোমিটার। ঝাড়গ্রাম পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি গন্তব্য। হবে নাই বা কেন! পাহাড়-প্রাসাদ, নদী-জঙ্গল, মন্দির-থান, বন্যপ্রাণী-লোকউৎসব, সব মিলিয়ে এক আকর্ষণীয় বনভূমি।

আমরা ঝাড়গ্রামকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে পর্যটনটা সেরে নিলে নিবিড়ভাবে ঝাড়গ্রামটাকে দেখতে পাব। প্রথম ভাগে আমরা ঝাড়গ্রাম শহরকে কেন্দ্র করে তার আশেপাশের জায়গা গুলোকে দেখে নিতে পারি। দ্বিতীয় ভাগে রাখবো ঝাড়গ্রামের উত্তর দিকের অংশগুলিকে এবং তৃতীয় ভাগে দক্ষিণ ঝাড়গ্রাম। কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম যেতে চাইলে সবচেয়ে সুবিধাজনক হাওড়া থেকে ট্রেনে ঝাড়গ্রাম। এক্সপ্রেস ট্রেনে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঝাড়গ্রাম পৌঁছে যাওয়া যায়। যারা সড়ক পথে আসতে চান তাদের ভায়া খড়গপুর লোধাশুলি হয়ে আসাটাই শ্রেয়। কলকাতা থেকে দূরত্ব প্রায় ২০০ কিমি। লোধাশুলি থেকে ডাইনে বাঁক নিয়ে প্রথমে লোধাশুলি জঙ্গল তারপরে শহরে ঢোকার আগে কলাবনি জঙ্গল পেরিয়ে অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রাম। এই অরণ্য পথ অত্যন্ত নয়নাভিরাম। কলাবনি জঙ্গলে ক্যানাল পাড়ে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করা যেতে পারে অরন্যের শব্দ আর গন্ধ। যারা ট্রেনে আসবেন তাদের আফসোসের কিছু নেই। দক্ষিণাংশ ভ্রমণের সময় পেয়ে যাবেন এই যাত্রার আনন্দ। এছাড়া মেদিনীপুর থেকে ধেরুয়া ব্রিজ দিয়ে কংসাবতী পেরিয়ে প্রবেশ করা যায় ঝাড়গ্রাম শহরে।

ঝাড়গ্রাম শহরের প্রধান আকর্ষণ ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। ১৯৩১ সালে রাজা নরসিংহ দেব এই রাজবাড়িটি তৈরি করেন। সুদৃশ্য তোরণ পেরিয়ে রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। প্রথমেই বামদিকে কাছারিবাড়ি। সেটি বর্তমানে এখন ভি.আই.পি গেস্ট হাউস হিসেবে পরিগণিত। তারপর মূল রাজবাড়ি। রাজবাড়িতে এখনো বংশধরেরা বসবাস করেন। রাজবাড়ির একাংশে ভ্রমণার্থীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা আছে। আর তোরণের আগেই পর্যটন উন্নয়ন দপ্তরের টুরিস্ট কমপ্লেক্স। আরেকটি মনোরম থাকার জায়গা হল বাঁদর ভোলা গেস্ট হাউস। এটি রাজবাড়ি থেকে প্রায় এক কিমি দূরে অবস্থিত এবং এটি ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের অধীন। বাঁদর ভোলা গেস্ট হাউস কমপ্লেক্সে একটি ট্রাইবাল মিউজিয়াম আছে। এখানে আদিবাসীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও কৃষিকার্যে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি প্রদর্শনের ব্যবস্থা আছে। ঝাড়গ্রাম কে চিনতে গেলে এটি অবশ্যই দেখতে হবে। যারা এসব জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন না, তাদের মন খারাপ করার কিছু নেই। ঝাড়গ্রাম শহরে অনেক সুন্দর সুন্দর গেস্টহাউস এবং হোটেল আছে। সেগুলোর খোঁজখবর নিয়ে অগ্রিম বুকিং সেরে ফেললেই হল।

ঝাড়গ্রাম শহরটি ছোট এবং সুসংবদ্ধ। সবকিছু হাতের কাছে। ঝাড়গ্রাম শহরের মত এত গাছ অন্য কোন শহরে আছে কিনা সন্দেহ। শুধু গাছ নয়, সুদীর্ঘ শাল গাছ আপনাকে মাথা তুলে আকাশ দেখতে দেবেনা। ঝাড়গ্রামে দুদিন থাকলে আপনার অরণ্য-নেশা ধরে যাবে। ঝাড়গ্রাম-লোধাশুলি রাস্তার যে পাশে রাজবাড়ি তার উল্টো দিকেই রাজপরিবারের কুলদেবী সাবিত্রী দেবীর মন্দির। এটিও সর্বেশ্বর মল্লদেবের প্রতিষ্ঠিত। এটি দালান মন্দির, ওপরে একটি চূড়া আছে। এখানে কোনো বিগ্রহ নেই, একগুচ্ছ চুল ও একটি খাঁড়াকে পূজা করা হয়। দেবী সাবিত্রী পাতাল প্রবেশের সময় সর্বেশ্বর চৌহান দেবীর চুলের মুঠিটি ধরে ফেলেন। তাই ওপরে থেকে রায় মায়ের হাতের খাঁড়া আর মাথার চুল। ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আছে ঝাড়গ্রাম জুলজিক্যাল পার্ক। আগে এটার নাম ছিল ঝাড়গ্রাম মিনি জু। অনেকে বলত ডিয়ার পার্ক। একটা বিকেল এখানে ঘুরে আসা যেতেই পারে।

এরপর যেতেই হবে ঝাড়গাম থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ডুলুং নদী তীরে চিল্কিগড়। এটি জামবনী থানার অন্তর্গত। এখানে নদীর পূর্ব পাড়ে কনক দুর্গা মন্দির। ‘জঙ্গলের মধ্যে মন্দির’ এর অনুভূতি টাই আলাদা। এখানে পূজিতা দেবী পিতলের তৈরি চতুর্ভূজা ও অশ্ববাহিনী। প্রাচীন পঞ্চরত্ন মন্দিরটি (১৭৪৯ খ্রী) ভগ্ন। বর্তমান মন্দিরটি ১৯৩৭ সালে নির্মাণ করান জামবনির রাজা জগদীশচন্দ্র ধবলদেব। জামবনি রাজবংশ ধলভূমগড় রাজবংশের শরিক। নদীর ওপার অপর পাড়ে মন্দির থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে জামবনি রাজবাড়ি। এই রাজবাড়িতে এখনো বর্তমান বংশধররা বসবাস করেন। এই রাজবাড়ির দর্শন পেতে হলে তাদের অনুমতি সাপেক্ষ। আর যাওয়া যেতে পারে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে আমলাচটিতে। এখানে আছে বন দপ্তরের ভেষজ উদ্যান। যত রকম ভেষজ গাছের আমরা নাম জানি এবং জানিনা, তা চাক্ষুষ করতে হলে যেতেই হবে এই ভেষজ উদ্যানে।

ঝাড়গ্রাম থেকে যাওয়া যেতে পারে লালগড় থানার অধীনে দুটি বিখ্যাত রাজবাড়ি, রামগড় ও লালগড়। এজন্য আমকোলা সেতু দিয়ে কংসাবতী নদী পেরোতে হবে। ঝাড়গ্রাম থেকে লালগড় এর দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার আর লালগড় থেকে রামগড়ের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। দুই সহোদর উদয়চন্দ্র ও গুনচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত দুই গড়-প্রাসাদ। এরা আদতে মধ্যপ্রদেশের এটোয়ার বাসিন্দা। গুনচন্দ্রের দুই ছেলে। রামচন্দ্রের নামে রামগড় এবং লক্ষণচন্দ্রের নামে লালগড় নামকরণ হয়েছে। উদয়চন্দ্রের কোন পুত্র ছিলনা বলে লক্ষনকে দত্তক নেন। রামগড়ের তেরো রত্ন কালাচাঁদ মন্দির এবং লালগড়ে রাধামোহনজীউর জোড় বাংলা মন্দির দুই রাজপরিবারের অপরূপ কীর্তি।

চলবে

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version