সুখেন্দু হীরা। ছবি: প্রতিবেদক

তৃতীয় পর্বে আমাদের পালা দক্ষিণ ঝাড়গ্রাম দর্শন। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বো গোপীবল্লভপুরের দিকে। কলাবনি, লোধাশুলি জঙ্গলের নয়নাভিরাম শোভা দেখতে দেখতে চলে আসবো মুম্বাই রোডের উপর লোধাশুলি মোড়। ডানদিকে মোড় নিয়ে কিছু দূর গিয়ে আবার ফেকো মোড়। ফেকো মোড়ের কাছে একটি পশু হাট বসে প্রতি মঙ্গলবার। এই হাটের ভালোই নামডাক আছে। ফেকো মোড় থেকে বামদিকে নিলে আমরা এসে উপস্থিত হবো সুবর্ণরেখা নদীর তীরে কুঠিঘাটে। কুঠিঘাট বেলিয়াবেড়া থানার অন্তর্গত। নদীর ধারে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। নীলকুঠি অবস্থানের জন্য এই জায়গার নাম কুঠিঘাট। আগে যখন সুবর্ণরেখার ওপর ব্রিজ তৈরি হয়নি, তখন ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর থেকে এই পর্যন্ত গাড়ি আসতো। তারপর নৌকায় নদী পেরিয়ে ওপারে গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রামে যেতে হতো। জায়গাটি ভারী সুন্দর। পাশে কালী মন্দির। ঠাকুর দোতলায়। হয়তো সুবর্ণরেখার ভয়ে এই ব্যবস্থা। সমগ্র জায়গা থেকে সুবর্ণরেখার দৃশ্য মনোরম। সেতুর উপর দিয়ে যাওয়ার সময় দুদণ্ড দাঁড়িয়ে সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখাকে দেখে নিতে ইচ্ছা করবে। বিশাল নদীবক্ষে যত না জল তার থেকে বেশি বালি। তবে বর্ষাকালের রূপ আলাদা। নদীর দুধারে বালি মাটিতে বাদাম চাষ। চাষের সময় নদীর চর ঘন সবুজ। সব মিলিয়ে সুবর্ণরেখা যেন রূপতাপস। ঝাড়গ্রাম থেকে কুঠিঘাট ৪৭ কিলোমিটার।

সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে সামান্য দূরে (দেড় কিমি) গোপীবল্লভপুর। গোপীবল্লভপুর প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন বৈষ্ণব তীর্থ। বৈষ্ণবাচার্য শ্রীশ্যামানন্দের শিষ্য শ্রীরসিকানন্দ তাদের কুলদেবতা এখানে প্রতিষ্ঠা করেন ১৬১০ সালে। ময়ূরভঞ্জ রাজার কাছ থেকে এই শ্রীগোবিন্দের বিগ্রহ লাভ করেন তার পূর্বপুরুষ। রসিকানন্দ ছিলেন রোহিণীর গ্রামের জমিদার পুত্র। তিনি নিজ গ্রাম ছেড়ে সুবর্ণরেখার তীরে এই নির্জন স্থানে বসবাস শুরু করেন। শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু এখানে বেড়াতে এসে তার সেবা গ্রহণ করেন। তখন শ্রীশ্যামানন্দ এই বিগ্রহের নামকরন করেন গোপীবল্লভ রায়। সেই থেকে এই স্থানের নাম গোপীবল্লভপুর। পূর্বে এই স্থানের নাম ছিল কাশীপুর। পঞ্চরত্ন মন্দিরে কষ্টিপাথরের শ্রীগোবিন্দ এবং অষ্টধাতুর শ্রীরাধিকা বিরাজ করছেন।

মন্দির দর্শন করে আমরা যাবো হাতিবাড়ি।গোপীবল্লভপুর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে সুবর্ণরেখার তীরে বন দপ্তরের একটি সুন্দর বাংলো আছে এখানে। প্রাচীন কোল রাজাদের হাতিশালা ছিল বলে এরকম নাম। সুবর্নরেখার নদী খাত এখানে শিলাময়। কুঠিঘাটের সুবর্নরেখাকে এখানে চেনা যাবেনা। সুবর্নরেখার তীরে সবুজ অরণ্যে সাজানো প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এখানে। হাতিবাড়ি থেকে সামান্য দূরে ঝিল্লি
পাখিরালয়। ঝাড়গ্রামের সবচেয়ে বড় জলাশয়। পাহাড় ধোয়া বৃষ্টির জল আর ওড়িশার দুটি খালের জল পড়ে এখানে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি হ্রদ। খুব সুন্দর। শীতকালে আসে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। বোটিং এর ব্যবস্থা আছে। ওয়াচ টাওয়ার আছে। দুটো কটেজ আছে। হাতিবাড়ি ও ঝিল্লি এ দুটি গোপীবল্লভপুর থানার মধ্যেই পড়ে।

এবার আমাদের গন্তব্য নয়াগ্রাম থানার অন্তর্গত রামেশ্বর মন্দির। আমাদের আবার ফিরে গোপীবল্লভপুর আসতে হবে। গোপীবল্লভপুর থেকে ধনকামড়া হয়ে বামদিকে রামেশ্বরের দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। সুবর্ণরেখার ধারে একটি টিলার উপর অবস্থিত মাকড়া পাথরের তৈরি ওড়িশা শৈলীর মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে দ্বাদশ শিবলিঙ্গের অবস্থান। মন্দিরের পূর্ব দিকে ১০৮ ধাপ সিঁড়ি নেমে এসেছে একটি পুকুরের পাশে। পুকুরটি কুন্ড পুকুর নামে পরিচিত। মন্দিরের পাশে বন বিভাগের তৈরি বাগিচা ও একটি ওয়াচ টাওয়ার এলাকার সৌন্দর্য অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। কথিত আছে, নয়াগ্রামের রাজা চন্দ্রকেতু স্বপ্নে পেয়েছিলেন শ্রী রামচন্দ্রকে। তিঁনি নাকি এই শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার আদেশ দেন। তাই এই শিব মন্দিরের নাম রামেশ্বর মন্দির।

এখান থেকে ৪ কিমি দূরে তপোবন। এটি বাল্মীকির তপোবন বলে পরিচিত। নির্বাসিতা সীতা এখানেই নাকি ছিলেন, এখানেই জন্ম লব কুশের। বাল্মীকির সমাধি, অনির্বাণ সীতাধুনি, সীতানালা, সীতাকুণ্ড, অশ্বমেধের ঘোড়া বন্ধন স্থান অর্থাৎ রামায়ণের সীতার বনবাসের প্রায় সব নিদর্শন এখানে বিদ্যমান। সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন, এখানের আদিম গন্ধমাখা অরণ্য আপনাকে এক অনন্য অনুভূতি এনে দেবে। ফেরার সময় আমরা রামেশ্বর হয়েই ফিরবো। চাঁদাবিলা হয়ে আসা যায় কিন্তু হাতির উপদ্রবের জন্য সে পথ এড়িয়ে চলাই ভালো।

ফিরতি পথে রামেশ্বর, ধনকামড়া, গোপীবল্লভপুর, ফেকো মোড়, লোধাশুলি হয়ে ফিরে আসতে পারি ঝাড়গ্রাম। যারা গাড়িতে কলকাতা ফিরবেন তারা লোধাশুলি থেকে গুপ্তমনি, খড়গপুর হয়ে ফিরে যেতে পারেন। যদি হাতে সময় থাকে আরো দুটো জায়গা দেখতে অনুরোধ করবো। প্রথমটি গুপ্তমনিতে। গোপীবল্লভপুর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে মুম্বাই রোডের ওপরে দেবী গুপ্তমনির থান। মুম্বাই রোডের ওপর দিয়ে যাওয়া মালবাহী এবং যাত্রীবাহী গাড়ি চালকদের অন্যতম পুজিত স্থান এটি। পুরোহিত লোধা সম্প্রদায়ের। সারা বছর নতুন গাড়ি পুজো দেওয়ার ধুম লেগেই থাকে।

গুপ্তমনি থেকে দক্ষিনে গুপ্তমনি-কুলটিকরি রাস্তা ধরে ৮ কিলোমিটার গেলে বাঁকড়া চক। সেখান থেকে এক কিমি বামদিকে পাথরকাটি গ্রাম। প্রত্নতাত্ত্বিক এই গ্রামে আছে জয়চন্ডী মন্দির। মাকড়া পাথরের তৈরি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষটি বোঝা যায়। বিগ্রহটিও ভগ্ন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বৌদ্ধ তন্ত্র দেবীর মূর্তি ছিল এটি। বর্তমানে পাশেই একটি নতুন মন্দির। পূজারী লোধা সম্প্রদায় ভূক্ত। কিন্তু সংস্কৃতে মন্ত্র পড়েন। এই গ্রামে কিছু পুরাতাত্ত্বিক জিনিস পাওয়া গিয়েছিল।

আমরা আবার গুপ্তমনিতে ফিরে আসবো। গুপ্তমনিতে ফিরে আমাদের ঝাড়গ্রাম ভ্রমণ শেষ করবো। ঝাড়গ্রাম জেলার বাইরের অধিবাসীদের ভ্রমণের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তবে বাকি থেকে যায় আরো অনেক কিছু। আদিম অরণ্য, অনামি টিলা, জনজাতি অধ্যুষিত গ্রাম, তাদের লোকসংস্কৃতি, তাদের লৌকিক শিল্প, তাদের লোক উৎসব, বন্যপ্রানীদের সতর্ক চলাফেরা, শীতকালে শালপাতার নিঃশব্দে পতন, গ্রীষ্মে মহুয়া ফুল ঝড়ে পড়া, প্রথম বৃষ্টির জল পেয়ে কচি সবুজ কেন্দু পাতা গজানো, আর কত বলবো। এসবের পরশ পেতে গেলে আপনাকে বারবার আসতে হবে ঝাড়গ্রাম। তবুও আশা মিটবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে, “আশ মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে।”

ঝাড়গ্রাম আপনার অপেক্ষায়…

শেষ…

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version