ইউক্রেন ইস্যুতে ভারত কি তার বিদেশ নীতিতে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেবে? যদিও  রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত পরিস্থিতিতে ভারত এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রসংঘে নিরপেক্ষ থেকেই বক্তব্য পেশ করেছে। গতমাসে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমের দেশগুলি যে রেজোলিউশন আনে তার ভোটাভুটিতে ভারত‘অনুপস্থিত’ ছিল। যা একভাবে রেজোলিউশনের ‘বিপক্ষে’ ভোট দেওয়া বলে মনে করা হয়। সে কারণে পশ্চিমের জোট এই নিয়ে মনে মনে ভারতের উপর ক্ষুব্ধ হয়। যদিওতারা ক্ষোভের প্রকাশ করেনি। তবে ভারতের এই ভূমিকায় রাশিয়া ভারতের দারুণ প্রশংসা করে।

এরপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেন নিয়ে ভারতের সঙ্গে  আলোচনা করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই যুদ্ধেদিকেই এগিয়ে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই অবস্থায় ভারতের পক্ষে কি নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হবে? আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি কঠিন হবে বলেই মত দিচ্ছেন। অন্যদিকে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে ঘরে বাইরে প্রশ্ন উঠছে।

উল্লেখ্য,রাশিয়া ইউক্রেনের দুই অঞ্চল ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক কে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মান্যতা দিয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার। ওই দুই এলাকায় প্রবেশ করতে রুশ সেনাকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এর পরেই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। তাতে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি ও কেনিয়া রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের উপরে হামলার তকমা দিয়েছে। ওই দেশগুলি জানায়, তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি ও অন্য পদক্ষেপ করবে।

কিন্তু ভারত ওই দেশগুলির সুরে সুর না মিলিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন সঙ্কট মেটানোর উপরে জোর দেয়।কিন্তু ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনও কথা বলেনি। দিল্লি যে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু দিল্লি এই অবস্থানে কতদিন থাকতে পারবে তা নিয়ে কূটনীতিকেরা যথেষ্ট সন্দিহান।ভারত কি এখনও ‘জোট নিরপেক্ষতা’র নীতিতে স্থির আছে,যদি না থাকে তাহলেকি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ভারত নিরপেক্ষ থাকতেপারবে?

দেশের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকেও এই প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়। যার উত্তরে জয়শঙ্কর-এর মন্তব্য, ‘আপেল আর কমলা তো এক নয়।’ উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে কোয়াডের মাধ্যমে ভারত-আমেরিকার সখ্যতা বেড়েছে। এরপরেও মার্কিন ‘হুঁশিয়ারি’ থাকা সত্ত্বেও ভারত এস- ৪০০ মিসাইল সিস্টেম কিনেছে রাশিয়ার কাছে থেকে।ভারতের চিন্তা চিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে হাতে রাখতে হবে। অন্যদিকে ভারত ইউক্রেন ইস্যুতে রাষ্ট্রসংঘে নিজেকে নিরপেক্ষ রাখার মতোই বক্তব্য পেশ করেছে। রাশিয়ার সমালোচনা না করে সুকৌশল বক্তব্যে দু’পক্ষকেই আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান সূত্র বের করার কথা জানিয়েছে।এই অবস্থানের কারণে রাশিয়া যেমন ভারতের প্রশংসা করেছে পাশাপাশি আমেরিকাও ভারতের উপর কোনও ‘চাপ’ সৃষ্টি করেনি। কিন্তু প্রশ্ন চিন নিয়ে,তারা এই বিষয়টাকে কিভাবে দেখছে? চিন তো ভারতকে বিপাকে ফেলতেই পারে।ইউক্রেন ইস্যুতে আমেরিকাকে বিপাকে ফেলতে সম্প্রতি চিন রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সূত্রের খবর অনুযায়ী, ভারতের এই ভারসাম্যের কূটনীতি আমেরিকা-সহ পশ্চিমের দেশগুলি এবং কোয়াড অক্ষের সদস্য দেশগুলিখুব একটা ভাল চোখে দেখছে না। কারণ, যখন তারা রাশিয়ার কড়া সমালোচনা করছে তখন ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুর না চড়িয়ে কার্যত মস্কোকে সমর্থনই করছে। তাই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের পক্ষে এই ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে উঠবে।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা ভারত গত সত্তর বছরের বেশি সময় কোনও দিন সরাসরি কোনও শিবিরে ছিল না। জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী-মোটামুটি এই পথেইও চলেছিলেন। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন এমনকি রাশিয়ারও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে জর্জ ডাব্লু বুশের আমলে আমেরিকায় আলকায়দার হামলার পর থেকে অবস্থাটা পালটায়। ভারত-আমেরিকার গভীর বন্ধুত্বের কারণে ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা ঠান্ডা মেরে যায়। তবে সৌদি আরব, সংয়ুক্ত আরব আমিরশাহীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হয়। এতে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্বে কোনও আঁচড় পড়েনি।

অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে  ভারতের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ থাকলেও যে ভারত আমেরিকার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ, নাতে না বলেএমনটা নয়। এটা, ‘কৌশলগত স্বতন্ত্রতা’। ইউক্রেন ইস্যুতে সবার সঙ্গে এক পথে না হেঁটে রাশিয়ার সমালোচনা না করে ভারত ভারসাম্য বজায় রাখলো। কারণ ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি’তে যে দুটি দেশ আছে, তাদের মধ্যে একটি ভারত, অপরটি চিন। আর ভারত বেশ ভাল করেই জানে এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমকে ঠেকাতে রাশিয়া চিনের কাছাকাছি যাবেই। কিন্তু ভারত এই ভারসাম্য কতদিন বজায় রাখতে পারবে, এতাও প্রশ্ন।

Share.

4 Comments

  1. রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত যে মতামত ব্যক্ত করেছে তাতে কি মনে হয় না যে দু-দেশের কৌশলগত সম্পর্ক যথেষ্ট ঠিকঠাক

  2. masudur rahman on

    যুদ্ধ ত লেগেই গেল ইউক্রেন আর রাশিয়ার। যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন। রুশ সেনা ঢুকে পড়েছে কিয়েভে। রুশ হামলার পর ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সাহায্য চাইলে কোন কূটনৈতিক পথে যাবে ভারত? ভারসাম্য বজায় রাখা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি?

  3. kunal chaterjee on

    ইউক্রেন ইস্যুতে রাষ্ট্রসংঘে চিনও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিল না। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিও ভারতের পথে হাঁটল। নিজেদের মধ্যে সীমান্ত সংঘাত থাকলেও চিন আর ভারত ইউক্রেন ইস্যুতে একই পথে রয়েছে।

  4. amarnath mondal on

    ভাল লেখা।
    ভারত বাস্তব অবস্থা বুঝে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন‍্য যে শক্ত মেরুদন্ড দেখাচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংশনীয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দেশের স্বার্থ ও গায়ের জোরই চলে। আদর্শ এখানে পিছন সারিতে।

Leave A Reply

Exit mobile version