পর্ব-চার

আড্ডা৷ বঙ্গজীবনের অন্যতম অঙ্গ৷ ছেলে-ছোকরা থেকে বুড়ো, নাতি-নাতনি থেকে ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, আট থেকে আশি, সকলেই আড্ডায় মশগুল হতে পছন্দ করেন৷ তা সে যেখানেই হোক৷ রকের আড্ডা হোক কিংবা ট্রেনের কামরায়৷ তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টার হইহুল্লোড়ে কাপের পর কাপ চা নিমেষে উড়ে যাওয়ার উত্সব সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় অনায়াসে৷ যে আড্ডা একসময় পুকুরপাড় বা পাড়ার রকে শুরু হয়েছিল, তা ট্রেনের কামরা কিংবা চায়ের ঠেক পেরিয়ে এখন ঢুকে পড়েছে সাইবার দুনিয়াতেও৷ হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জারে৷ মুখোমুখি বসে আড্ডার দুনিয়া এখন অনেকটাই বদলেছে৷ ব্যস্ততার ফাঁকে এখন কথা  হয় ভার্চুয়ালি৷ আঙুলের স্পন্দনে এগিয়ে চলে বার্তালাপ৷ সঙ্গে থাকে ইমোজি৷ যা বুঝিয়ে দেয় আমি রেগে গেলাম৷ নাকি আনন্দ পেলাম৷ নাকি মশকরা করছি৷ বিভিন্ন জায়গার আড্ডার চরিত্র অবশ্যই আলাদা৷ তবুও ফলাফল অবশ্যই এক৷ সর্বত্রই মেলে নির্ভেজাল আনন্দ৷

আমাদের পাড়ায় যেমন আড্ডার মূল জায়গা ছিল একটা শানের ঘাট৷ তার পাশেই ছিল গ্রামের এক চিলতে মাঠ৷ সেখানে হরেক সিজনে নানারকম খেলা চলত৷ গরম থেকে বর্ষায় ফুটবল খেলা ছিল মাস্ট৷ পুজো পেরোলেই ব্যাট-উইকেট নিয়ে নেমে পড়া হত৷ আর খেলার বিরতিতে কিংবা শেষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা চলত সেখানে৷ সন্ধে নামলে কিংবা বেলা বয়ে গেলেও কেউ তোয়াক্কা করত না৷ সেখানে সদস্যরা সকলেই কিশোর থেকে সদ্য যুবক৷ ফলে আড্ডার বিষয়ও সেরকম হত৷ তাছাড়া পাড়ার যে কোনও বিপদে এরাই ত্রাতার ভূমিকা নিত৷ আবার আড্ডার ফাঁকে কত যে প্রেম-প্রণয় তৈরি হত, তাও হাতে গুনে বলা সম্ভব নয়৷আমাদের পাড়ায় কোনও রক ছিল না৷ তাই আড্ডা দেওয়ার জন্য শানের ঘাটই বেছে নেওয়া হয়েছিল৷ তবে রকের আড্ডাও এই একই গোত্রে পড়বে৷ সেখানেও ছেলে-ছোকরাদের ভিড়ই বেশি দেখা যায়৷ সেখানেও তারা পাড়ার বিপত্তারণ হয়ে দেখা যায়৷ সেখানেও গড়ে ওঠে নতুন জীবনের গল্প৷ট্রেনের আড্ডাটা আবার অন্যরকম৷

যাঁরা নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন, তাঁরা এর স্বাদটা ভালই বোঝেন৷  এখানে বয়সের কোনও ভেদাভেদ থাকে না৷ যে কোনও বয়সের লোক এখানে ভিড় জমাতে পারেন৷ তবে শর্ত আছে কিছু৷ যেমন, একই ট্রেনে রোজ যাতায়াত করতে হবে৷ আর উঠতে হবে একই কামরার একই জায়গায়৷ আর আড্ডার পুরো মজা নিতে হলে যেতে হবে অনেকটা দূর৷ না হলে সবটাই মাটি৷ বাঙালির আড্ডা দেওয়ার আর দুটি সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল চায়ের ঠেক আর কফি হাউস৷ চায়ের ঠেকে যে আড্ডার সূচনা হয়েছে, তার কৌলিন্যপ্রাপ্তি ঘটে কফি হাউসে৷বাঙালির আড্ডায় কতগুলি বিষয় নির্দিষ্ট৷ যেমন, চা বা কফি৷ সন্ধ্যার দিকে হলে মুড়ি-চানাচুর-তেলেভাজাও চলে৷ আর ট্রেনের কামরার আড্ডায় খাবার নির্ভর করে হকারের উপর৷ সেখানে খাবার যেমন মেলে, তেমনই খাওয়া হয়৷ বাঙালির যে কোনও ধরনের আড্ডায় তাস ম্যান্ডেটরি৷ রক বা ট্রেনের কামরা, সর্বত্রই রমরমিয়ে চলে তাসের আসর৷ বাজি ধরাও চলে উপর্যুপরি৷ সবসময়ই তা খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে৷

বেশ কিছু চরিত্র এমন থাকে, যাদের আমরা যে কোনও আড্ডার জায়গাতেই খুঁজে পাব৷ যেমন, একজন হাড়কিপ্টে অবশ্যই থাকবে৷ একজন থাকবে, যে সবচেয়ে বেশি বোঝে৷ সব বিষয়েই তার অগাধ পাণ্ডিত্য থাকবে৷ আর একজন ভাল গোবেচারা থাকবে৷ যারা সবসময়ই কারও না কারও হেনস্তার শিকার হবে৷রক, ট্রেনের কামরা, চায়ের ঠেক, কফি হাউসের আড্ডা আগে যেমন ছিল এখনও তাই আছে৷ আগামিদিনেও তাই থাকবে৷ একবারে স্বমহিমায়৷ এখন শুধু যুক্ত হয়েছে ভার্চুয়াল আড্ডা৷ যা আমাদের সদাব্যস্তময় জীবনে এক পশলা বৃষ্টির মতো এসে হাজির হয়েছে৷ হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জারে তাই এখন গ্রুপের ভিড়৷ কোনও গ্রূপ স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে৷ আবার কোনওটাতে রয়েছে শুধু কলেজের বন্ধুরা৷ এখানে মুখোমুখি বসার সুযোগ হয় না৷ তবে আড্ডা চলে দিনভর৷ ফিরে আসে শৈশবের স্মৃতি৷ হয়ে যায় রি-ইউনিয়ন৷তাই রক থেকে ডিজিটাল, বাঙালির আড্ডা যুগ যুগ জিও…৷

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version