দুনিয়ায় এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে এখনও ফুটবল খেলা হয়না, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ ফুটবল খেলা সম্পর্কে তেমন খবরও রাখেন না। মনগড়া কথা নয়, ১৯৯৪ সালে যখন আমেরিকায় ফুটবল বিশ্বকাপ হচ্ছিল তখন এক সমীক্ষায় জানা যায়, সেখানকার ৩৬ শতাংশ মানুষ জানতো যে ফুটবল নামে একটা খেলা আছে। তার মানে কি এই যে তারা পেলের নাম জানতো না। যদিও ওই ৩৬ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষ জানতো যে ফুটবলের বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট হয়। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই কারণ, আমরা অনেকেই জানিনা রাগবি বিশ্বকাপ কবে-কোথায় হবে কিংবা বাস্কেটবলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কোন দেশ। কিন্তু দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্তো নামটি না জানলেও পেলের নাম জানেন। উল্লেখ্য, তাঁর এই নাম রাখা হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামের কথা মনে রেখেই। তবে পেলের জনপ্রিয়তার কথা বলার আগে কোনো সমীক্ষার দরকার পড়েনা। কেবলমাত্র এটুকুই বলা যায়, একটা খেলার সঙ্গে নিজেকে সমার্থক বানিয়ে ফেলার কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন যিনি, ফুটবল সম্পর্কে কিছুই জানেন না এমন মানুষও পেলের নাম শুনেছেন। তাই ফুটবল বললেই প্রথমে এবং সবশেষে পেলের নামই আসবে। ফুটবল বা সেই সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে তাঁকে হয়তো কেউ কেউ ছাড়িয়ে যাবেন কিন্তু পেলের জায়গায় আরেকজনকে বসানো মনে হয় না সম্ভব।

পেলে পরবর্তী কালে ফুটবলের সঙ্গে এসেছে ম্যারাডোনা, রোনালদো, রোনালদিনহো, মেসি ইত্যাদি নাম। কিন্তু পেলে ফুটবলের সম্রাট। পেলে সর্বশেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন ১৯৭০ সালে, তারপর ১৩টি বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেলেও ফুটবল বিশেষজ্ঞদের যেকোনো তালিকায় কিন্তু পেলের নামটি থাকে প্রথমে। এমনকি পেলের পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেখানোর পরও বেশির ভাগ ফুটবল বিশেষজ্ঞের মতে এক নম্বর জায়গাটিতে তাঁর নামটিই অপরিবর্তিত থেকে যায়। ২০০০ সালে IFFHS বা International Federation of Football History & Statistics প্রাক্তন খেলোয়াড় আর সাংবাদিকদের ভোটে যে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করে তাতে ১৭০৫ ভোট পেয়ে পেলেই পেয়েছিলেন প্রথম স্থান। ফুটবল সংক্রান্ত প্রায় সব বিষয়েই যে তাঁর নাম প্রথমে চলে আসে তার কারণ কেবল ফুটবলার নন, জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী এক যোদ্ধার নাম হল পেলে।

ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মানো পেলে পরিবারের অভাব অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলায় চায়ের দোকানে কাজ করেছেন, রেলস্টেশনে ঝাড়ু দিয়েছেন, কিছুদিন জুতো পালিশ করার কাজও করেছিলেন। এরপরও ফুটবলে তাঁর সহজাত প্রতিভা লক্ষ্য করা যেত ছেলেবেলাতেই। কিন্তু ফুটবল কেনার টাকা ছিল না তাই মোজার ভেতরে কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবল দিয়েই বস্তির গলিতে চালাতেন অনুশীলন। গলির ফুটবলেই পেলের প্রতিভা ধরা পরেছিলো। একদিন ওই গলি থেকে উঠে আসা কিশোর ফুটবলারের উপর নজর পড়ে সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। তা না হলে হয়তো পেলের প্রতিভা গলিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যেত। ব্রিটো পেলেকে গলি থেকে নিয়ে যান সান্তোস ক্লাবে এবং সান্তোসের ‘বি’ টিমে সুযোগ দেন পেলেকে। সেখানেও পেলে তাঁর সহজাত ফুটবল প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মধ্যে সান্তোসের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন। সেবার ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে সান্তোসের হয়ে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি পেয়েছিলেন তিনি। লিগে তাঁর পারফরম্যান্স এতটাই নজরকাড়া ছিল যে,  ব্রাজিল সরকার আইন করে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো ক্লাব পেলেকে দলে নিতে চাইলেও সরকারের অনুরোধে পেলে কোনো দিন ইউরোপিয়ান লিগে খেলতে পারেননি। ইউরোপিয়ান লিগে খেললে পারলে পেলে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতেন, কিন্তু সরকারের অনুরোধে দেশের স্বার্থে সেটা তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল।  

কিন্তু ফুটবলার পেলের কীর্তি ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই প্রথম বিশ্বকাপ খেলা। সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলে হেরে গেলেও প্রথম ম্যাচেই বিশ্বরেকর্ডটি করতে ভুল করেননি পেলে। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে তিনি অর্জন করেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড। উল্লেখ্য, ম্যারাডোনা ২২ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন। রোনালদো ১৮ বছর বয়সে। মেসি ১৯ বছর বয়সে বিশ্বকাপ একাদশে সুযোগ পান। কিন্তু সবগুলো ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি। এরপর সেমিফাইনালে পেলে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক, সেটিও বিশ্বরেকর্ড। ফাইনালেও দু’গোল করে সেই বিশ্বকাপের সিলভার বল ও সিলভার বুট দুটোই জেতেন পেলে। এছাড়া সেই বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকার পুরষ্কারও জেতেন তিনি। পুরো ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৯২টি হ্যাট্রিক, ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসাবে ৭৭তি গোল, ক্যারিয়ারে ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮৩ গোল। ইউরোপীয় ফুটবলে কখনো খেলেননি কিন্তু জাতীয় দল এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে ১৩০ ম্যাচ খেলে ১৪২ টি গোল করেছিলেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version