সাম্যবাদ  এদেশে যদি কোথাও থেকে থাকে, তা আছে ছটা-চল্লিশের কৃষ্ণনগর লোকালের এই সেকেন্ড লাস্ট  কম্পার্টমেন্টে। আমার এই গভীর উপলব্ধিকে একবাক্যে মেনে নেন বাকিরা। না মেনেই বা উপায় কী! সাত সন্ধের এই ট্রেনে কী রকম ভিড় হতে পারে সহজেই আন্দাজ করা যায়। কোনোদিন এতে জায়গা পাওয়া যায়, কোনোদিন দুই সিটের মাঝে দাঁড়ানো। কোনোদিন তাও না।হ্যান্ডেল ধরে ঝোলাঝুলি প্রায় অর্ধেক পথ। তারই মধ্যে এক গামছায় একদান রংমেলান্তি হেড অফিসের বড়বাবু থেকে গরম চা ভাই-এর, কলেজের অধ্যাপক থেকে বেসরকারি ব্যাঙ্কের সিকিউরিটির। দান শেষ হলেই খোলা হবে জজসাহেবের টিফিন বাক্স। তাতে কড়া পাকের সন্দেশ, ড্রাই ফ্রুটস, কিছু গোটা ফল। কোলে মার্কেটের টমেটো মুলো পেঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে চমৎকার মুড়ি মাখে বিনোদ ভাই। আহা! কী স্বাদ। চা-ভাই কেটলির শেষ চাটুকু ঢালতে থাকে কাগজের কাপে কাপে। ততক্ষণে অবশ্য এ দলের সবারই মোটামুটি কোমর ঠেকানোর ব্যবস্থা হয়ে যায়।

সেদিন আমি বাগিয়েছি জানলার ধারখান। নামবো তো সেই শিয়ালদহ। রোজকার মতোই ভিড় ঠাসা। বিনোদভাই মুড়ি মাখতে মাখতেই ট্রেনে উঠে পড়েছে, অভিজিত আর তার বন্ধুও। ওরা কোনো এক অডিও ভিস্যুয়াল চ্যানেলে চাকরি করে। যত ভিড়ই থাক, দেখে দেখে ঠিক এই কামরাতেই  উঠবে প্রতিদিন। অন্য কামরা  থেকে গান ভেসে আসছে। স্বপনদা আর মঞ্জুদির। ভিড় ঠেলে ওরাও আস্তে আস্তে এসে পড়লো এই কামরায়। ওরা এলে আমরা চেষ্টা করি,  যেভাবে হোক একটু সিটের কোণা ম্যানেজ করে দিতে। লোভটা গান শোনার। বড় ভালো  গায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতই গায় মূলত। মঞ্জুদির গলা ততটা ভালো না। স্বপনদার গলায় যাদু আছে। প্রথমদিকে কেউ কেউ ওদের প্রতি আমাদের দাক্ষিণ্য দেখে বেশ বিরক্ত হত, আঁকাবাঁকা দু-চার কথা শোনাতেও ছাড়তো না। এখন অল্পবিস্তর সবাই ওদের গানের ভক্ত। ওরা গান শুরু করলে আপনা থেকেই আমার চোখটা বন্ধ হয়ে আসে। দমবন্ধ ভিড়, নাকে চোখেমুখে গিলে ছোটা, ছুটতে ছুটতে জীবনের ওঠা নামায় সামিল হয়ে পড়া– সব এক নিমেষে উধাও। পরতে পরতে খুলে যাওয়া জীবনের সব সুন্দরেরা যেন হাতের মুঠোয়। আড়াই মিনিটে গভীর থেকে এক গভীরতর অবগাহন। এই ইঁট কাঠের পৃথিবীতে ওদের আমার বড় অন্য রকম লাগে। আমরা   যে গানটা ওদের গলায় শুনতে সবচেয়ে ভালবাসি– ‘চোখের  আলোয় দেখেছিলেম …’, আমার আর বিরাটি স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের অনুরোধে সেদিনও সেই গানটাই ধরেছে। মুগ্ধ হয়ে শুনছি। প্রতিটা শব্দ মূর্ত হয়ে উঠছে। অন্তরের চোখ ছাড়া এমন উচ্চারণ অসম্ভব!

বেলঘরিয়া আসার মিনিট দুয়েক আগে ওরা উঠে পড়লো। তখনও ট্রেনে বেশ ভিড়। প্রতিদিনের তুলনায় একটু বেশিই বোধহয়। ভিড় ঠেলে তড়িঘড়ি এগোচ্ছে। এবার নামবে। একজনের মস্ত সাইড ব্যাগে আটকে গেল মঞ্জুদির কাপড়ের ব্যাগ, হুড়মুড়িয়ে পড়ল প্লাটফর্মে। স্বপনদা  কোনোক্রমে নামল। ট্রেনের ভেতর থেকে আমরা চিৎকার করছি তারস্বরে। সবারই তখন বড্ড তাড়া। সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার তাড়া। ‘চোখের আলো’য় পোঁটলা পুঁটলি মাড়িয়ে বাড়ি ফিরছে সবাই। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। জানলায় চোখ রেখে দেখছি, জানলার ওপারে পরম মমতায় মঞ্জুদিকে তুলছে স্বপনদা। মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে হাত দিয়ে। আর আমরা এক জন্মান্ধ ভিখিরি দম্পতির সম্পর্কের মায়ায় জারিত হচ্ছি, দগ্ধ হচ্ছি।  

কানে তখনও বাজছে ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।অন্তরে আজ…’।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version