ভিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, রবি দহিয়া, দীপক পুনিয়া। এঁরা জানুয়ারি মাসে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা বৃজভূষণ শরণ সিং এর বিরুদ্ধে যৌন ও মানসিক নির্যাতন ও আর্থিক অনিয়মের লিখিত অভিযোগ তুলেছিলেন। দাবি জানিয়েছিলেন পদের থেকে তাঁর অপসারন এবং বর্তমান কমিটির অবসান। এও জানিয়েছিলেন যে নতুন কমিটি তৈরি করতে হবে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে। সরকার তখন সঙ্গে সঙ্গে অভারসাইট কমিটি গড়ে। মেরি কমের নেতৃত্বাধীন এই কমিটিতে ছিলেন যোগেশ্বর যাদব, তৃপ্তি মুরগুন্ডে, রাজেশ রাজাগোপালন, রাধিকা শ্রীমান। কমিটি নিয়ে কুস্তিগীররা অসন্তোষ প্রকাশ করলে পরে ববিতা ফোগতকে কমিটিতে আনা হয়।  সরকারি কমিটি অবশ্য দুপক্ষের কথা শুনে টুনে তাদের রিপোর্ট সরকারকে জমা দিয়ে দিয়েছেন। সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসেনি আর। এই কমিটির সদস্য ববিতা ফোগত অবশ্য অভিযোগ করেছেন তাঁকে নাকি পুরো রিপোর্ট পড়তে দেওয়া হয়নি। এই রিপোর্টে কমিটির পাঁচ সদস্য অবশ্য অভিযুক্তকে নির্দোষ বলে মেনে নিয়েছেন। অবশ্য অভিযোগকারীরা জবানবন্দী দেওয়ার সময় ভিডিও বার বার অফ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন। বলেছেন তাদের অনেককে দিয়ে এমনকি জবাববন্দী ভেরিফাইও করানো হয়নি। কাউকে কাউকে জবানবন্দী চলাকালীন আগামী কেরিয়ারের ভয় দেখানো হয়েছে।

ইন্ডিয়ান অলিম্পিক এসোসিয়েশন আলাদা করে তদন্ত কমিটি গড়ে। লক্ষণীয় যে এঁদের নিজস্ব আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি থাকলেও এদের আলাদা করে কমিটি গড়তে হয়।  তাতে ছিলেন মেরি কম, দোলা ব্যানার্জী, অলকনন্দা অশোক, যোগেশ্বর যাদব, সহদেব যাদব আর দুজন অ্যাডভোকেট তালিশ রায়, শ্লোক চন্দ্র। জানুয়ারী মাস থেকে এই কমিটি এখনও তদন্ত করে চলেছে। এরই মধ্যে পি টি ঊষা অভিযোগকারীদের শৃংখলাবোধ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছেন।

ইতিমধ্যে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপে পুলিশ মে মাসের শেষে এফ আই আর নিতে বাধ্য হয়। তার মধ্যে একটি অভিযোগ POCSO ধারার অধীনে। সেই তদন্তও চলছে। বৃজভূষণ শরণ সিং ৯০ এর দশকের রামজন্মভূমি আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। ছয় বারের এমপি। ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক। কাজেই ক্ষমতাশীল এই নেতার বিরুদ্ধে যে সহজে কোন পদক্ষেপ করা হবে না, এটা খুবই সহজবোধ্য। ইতিমধ্যেই অযোধ্যার সাধুরা স্থির করেছেন তাঁরা POCSO আইনে বদল আনার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করবেন। এতে নাকি অযথা তাদের আশীর্বাদ-স্পর্শের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বৃজভূষণ নিজেও বলেছেন তাঁর স্পর্শ নির্দোষ ছিল।

অভিযোগকারীরা বার বার আন্দোলনকে অরাজনৈতিক বললেও এই মুহুর্তে আন্দোলনের চেহারা খুবই স্বাভাবিক-ভাবেই বিজেপি-বিরোধী। বিজেপির সমর্থকেরাও দল-বেঁধে সরকারকে প্রশ্নহীন আনুগত্য উপহার দিয়ে চলেছেন। টুইট্যারে, ফেসবুকে তাদের গর্জন-তর্জন চলেছে, কোথাও অভিযোগকারীদের পার্টিতে নাচার ছবি দিয়ে তাদের আদর্শ ভারতীয় নয় বলে প্রমাণের চেষ্টা চলছে,  তাঁদের মেডেল বিসর্জনের ঘটনার প্রেক্ষিতে কেউ বা বলছেন, সরকারের থেকে পাওয়া সব টাকা, সব সুযোগ সুবিধাও ফেরত দেবে তো? আর তার বিপ্রতীপে অসমর্থকরাও বিজেপি-বিরোধীতার সুর চড়াচ্ছেন ধাপে ধাপে।

আর এই সমর্থক-বিরোধীদের দলের বাইরে আছেন একটা বিরাট সংখ্যক জনগণ যারা কিন্তু অনেকাংশেই নীরব। নিশ্চুপ। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। এঁরা শোভন-বৈশাখীর ‘কেচ্ছা’ নিয়ে বিভিন্ন সমাজ-মাধ্যম সরগরম করেন। কিন্তু এই বিষয়ে মুখ খোলার তাদের ইচ্ছা বা দরকার কোনটাই হয় না। 

এই নির্লিপ্তভাবটা খুঁড়তে বসলে যে সত্যগুলো বেরিয়ে আসে সেগুলো ভয়ের। এঁরা বিশ্বাস করেন, এগুলো ফালতু ব্যাপার। কেউ বলেন মেয়েরা নজর-কাড়ার জন্য এইসব অভিযোগ আনেন। কেউ বলেন, এসব ‘ভাল’ মেয়েদের সঙ্গে হয়না। কেউ বা বলেন, এক হাতে তো আর তালি বাজে না। মেয়েটিরও দোষ ছিল। কেউ আবার বলেন, স্নেহের স্পর্শকে বিকৃত চোখে দেখা হচ্ছে। হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ আনা মেয়েকে বলা হয়েছে, আরও তো কত মেয়ে রয়েছে, তাদের কিছু হল না, শুধু তোমার সঙ্গেই এমন ঘটনা ঘটে কেন বলতো? আবার কেউ কেউ বলেন, আমার তো গায়ে আঁচ লাগেনি, তাই আমার তাতে কি?

উল্টোদিকটাও ভীতিপ্রদ। অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা যাঁরা এই ঘটনাকে নক্ব্যারজনক বলছেন, তাঁরাও অনেকেই বিশ্বাস করেন যে মেয়েদের দুর্বলতার কারণেই এই সব ঘটে। তাই পুলিশি সহায়তায় মেয়েদের ‘সবলা’ করে তোলা হয়। দিকে দিকে মেয়েদের জন্য ক্যারাটে, তায়কন্ডর প্রশিক্ষণ শিবির বসিয়ে এঁরা মেয়েদের জন্য কিছু তো করা গেল ভেবে খুশি হন। প্রকৃতপক্ষে ভিনেশ ফোগত নিজেই অতীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তার সঙ্গে লোকে পাঙ্গা নিতে আসে না। কেউ কেউ বলছেন যে এসব আসলে পারিবারিক মূল্যবোধ শিক্ষার অভাব। এদেশের উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান পরিবারগুলোতেও কত যে গোপনে গোপনে শিশু নির্যাতন ঘটে তার কিন্তু কোন ইয়ত্তা নেই।

অথচ আমাদের দেশে বাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বন্ধের জন্য আইন আছে। এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্কদের সুরক্ষার জন্য আলাদা করে POCSO আইনও আছে। আইনী রক্ষাকবচ কি করে কাজে আসবে যদি দেশের জন-সাধারণের সচেতনতা তৈরি না হয়? সমস্যা এই যে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা রদের ২০১৩ সালের আইন অনুসারে সব কর্ম ক্ষেত্রে একটি করে আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি থাকার কথা। মেরি কম কমিটির রিপোর্ট বিভিন্ন সংস্থায় এই কমিটি না থাকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করেছেন। অথচ আইন অনুসারে প্রতিটি সংস্থায় এই কমিটি তৈরি বাধ্যতামূলক। কিভাবে তৈরি করতে হবে সে বিষয়েও নির্দিষ্ট নিয়ম আইনে বলা আছে। সংস্থার এক সিনিয়র লেভেলের মহিলা কমিটির মাথা হবেন। কমিটিতে অন্তত দুজন মহিলা থাকবেই, আর একজন কোন বাইরের এনজিওর প্রতিনিধি থাকবেন যার মেয়েদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে ও যৌন হেনস্থার দিকগুলো জানেন-বোঝেন। ২০১৩ সালের আইন মেনে কটা জায়গায় এই কমিটি তৈরি হয়েছে? অবশ্য এই কমিটির একটা দায়িত্ব ছিল প্রতি বছর একটি করে রিপোর্ট তৈরি করে কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসনের কাছে দাখিল করার। রিপোর্ট দাখিল করার কোন সিস্টেম কি সর্বত্র চালু হয়েছে?

কিন্তু তার থেকেও বড সমস্যার কথা এই যে আইন-মোতাবেক যে কমিটি করার কথা তাতে মহিলা উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হলেও, সেই মেয়েদের নারী-চেতনা কতটা জেগেছে তা বোঝার কোন উপায় নেই। লিঙ্গের দিক দিয়ে নারী হলেও সকলেই কি সমান ভাবে সচেতন হন? যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতি মুহূর্তে মানুষের মগজধোলাই করে, সেই সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা মেয়েদের নারীর অধিকার নিয়ে সচেতন হতে হলে প্রতি মূহুর্তে আগে শেখা জিনিস ভুলতে হয়, নিজেকে শেখানো চিরাচরিত বুলির বাইরে অন্যরকম ভাবনা ভাবার জন্য প্রস্তুত করতে হয়। আর সেই সঙ্গে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়, ঠিক পথে চলছি তো? নিজের ন্যায় বিচারের ক্ষমতাকে প্রতি মুহুর্তে প্রশ্ন করতে হয়। সেই যাত্রা মোটেই খুব সহজ নয়। বিশেষত হ্যারাসমেন্টের যে দিকটি শারীরিক ছোঁয়া বর্জিত, সেই ক্ষেত্রে সুবিচার করা সাধারণ মানুষের জন্য খুব সহজ কাজ নয়। অজস্র নিজস্ব বায়াস পথ জুড়ে দাঁড়ায়। বহু আলোচনা, বহু পড়াশোনা, বহু আত্ম-সমীক্ষণ না করলে এই বায়াস চেনাও সহজ না। কতজন স্বেচ্ছায় এই কঠিন আত্ম-বিশ্লেষণের পথ বেছে নেন? চার মহিলা-সদস্য যুক্ত মেরি কমের কমিটিই প্রমাণ করে যে অনেক মেয়েই এখনও যথেষ্ট সচেতন নন। সেটাই যদি হতেন, তাহলে বাড়ির মধ্যেই মহিলা-সদস্যের হাতে আরেক জন  মহিলা নির্যাতিত হতেন না। সেই ক্ষেত্রে আমরা দাগিয়ে দিই, মেয়েরা মেয়েদের শত্রু বলে। বহু আপাত-সচেতন মেয়েও এই ভুলটা করেন। আসলে কিন্তু মেয়েরা নিমিত্ত মাত্র। আসল শত্রু হল পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা

শুধু জন্মগত লিঙ্গের কারণে কেউ মসীহাও হন না, কেউ অপরাধীও হন না। না ছেলেরা, না মেয়েরা। প্রতিটা সুত্র লুকিয়ে থাকে তার বেড়ে ওঠার পথে পথে। যে পোড়ার দেশে বধূ-নির্যাতনের অভিযোগ চেপে দিয়ে সেই ছেলেরই হাতে কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মা পরের কন্যাটিকে সমর্পণ করেন, যে দেশের সমাজ জাত-পাত-ধর্ম-শ্রেণি দেখে তবেই প্রতিব্বাদ মুখর হয়, প্রতিটা অন্যায় কাজে সামাজিক ভ্যালিডেশন জুটে যায়, ধর্ষণের অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত স্বামী-পুত্রের হয়ে সাফাই গান তাঁরই পরিবারের অন্যরা, সে সমাজে অন্য কিছু কি আশা করা যায়?

ইতিমধ্যে সরকারি কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্পোর্টস সংস্থাকে অবিলম্বে আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। নেই মামার চেয়ে কানা মামা অবশ্যই ভাল। কিন্তু এই ঘোর পিতৃতান্ত্রিক দেশে সেইটুকু কতটা যথেষ্ট সেই বিষয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। তবে এই ঘটনার সব থেকে বড় ট্র্যাজেডি এই যে শেষ অবধি কুস্তিগীরদের হয়ে দাবি আদায়ের দায়িত্ব চলে গেছে খাপ-নেতৃত্বের হাতে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আগামী পাঁচ তারিখের মধ্যে যদি বৃজভূষণকে গ্রেপ্তার না করা হয়, তাহলে তারা বড় আন্দোলনের ডাক দেবেন। সেই খাপ-পঞ্চায়েত মেয়ের অসম্মান, অবমাননা এমনকি মেয়েদের বিচার-বহির্ভূত খুনের রক্তে যার হাত রঞ্জিত! কৃষক-আন্দোলনের জয় তাদের মুঠোয় এলেও, পাঞ্জাব হরিয়ানায় মেয়েদের কৃষি-জমির মালিকানা আজও অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে খুঁজে বার করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সুবিচার যদি বা শেষ অবধি মেলেও, কোন মূল্যের বিনিময়ে? আর জাঠ মেয়েদের যদিও বা খাপের আনুকূল্য জোটে, দেশের অজস্র সুবিচার প্রার্থী ভিন জাতের নগণ্য মেয়েদের কি হবে? এদেশে হেনস্থাকারীর তো কমতি নেই। হায় রে, দুর্ভাগা দেশ আমার!

(শেষ)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version