শেষ পর্যন্ত ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের লড়াইয়ে হেরে গেলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক।আশা জাগিয়েও ছুঁতে পারলেন না মাইলস্টোন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে জোর ছুট লাগিয়েও শেষ হাসি হাসতে পারলেন না ঋষি। ব্রিটিশ নেত্রী লিজ ট্রাসের উপরই ভরসা রাখলেন কনজারভেটিভ দলের নেতারা।ভোটের ব্যবধান কম হলেও পরাজয় মানতে হয়েছে তাঁকে আর জয় কেড়ে নিয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কুরশি দখল নিয়েছেন লিজ ট্রাস। উল্লেখ্য, বরিস জনসন ইস্তফা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, ঋষি সুনাকই প্রথম পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নেমেছিলেন। অন্যদিকে, শেষ প্রার্থী হিসেবে এই দৌড়ে যোগ দিয়েছিলেন লিজ। ঋষি প্রথম থেকেই জোরদার লড়াই দিয়ে সাদা চামড়ার বহু পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদকে পিছনে ফেলেছিলেন। লড়াই দ্বিমুখী হওয়ার পর থেকে তাঁর জয়ও প্রায় নিশ্চিত ছিল কিন্তু শেষদফায় এসেই অনেকটা পিছিয়ে পড়েন তিনি। কেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে পরাজিত হলেন ঋষি সুনাক? পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার স্ত্রী অক্ষতাকে নিয়ে বিতর্কের জেরেই কি তীরে এসে তরী ডুবল ঋষির?

চলতি বছরের গোড়া থেকেই ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি এবং চেয়ারপার্সন সুধা মূর্তির মেয়ে অক্ষতা সে দেশে চর্চার কেন্দ্রে। সম্পত্তি, আয়কর এবং রাশিয়ার সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’-এর কারণে অক্ষতা তদন্তের আওতায় ছিলেন। ব্রিটেনের বাইরের বাসিন্দা কিন্তু পেশা সূত্রে ব্রিটেনে বসবাস, তাদেরও ব্রিটেন সরকারকে একটি বিশেষ কর দিতে হয়। অক্ষতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ‘প্রভাব খাটিয়ে’ সেই কর ফাঁকি দিয়েছেন।

সানডে টাইমসের ধনী তালিকায়ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের থেকেও বেশি ধনী অক্ষতা মূর্তি। আগস্ট মাসে লেবার পার্টি ঋষি সুনাকের ব্যবসার তহবিল সংগ্রহের জন্য ঋণ গ্রহণের বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা দাবি করার পরই তাঁদেরমোট সম্পত্তি নিয়ে কাঁটাছেঁড়া শুরু হয়। অক্ষতা মূর্তি ইনফোসিস সংস্থার ০.৯৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক, যার মূল্য ৬৯ কোটি ইউরো। এদিকে, অক্ষতা এখনও ভারতীয় নাগরিক। ব্রিটিশআবাসিক না হওয়ায় তিনি ব্রিটেনে কর দিতে দায়বদ্ধ নন। সেই কারণে গত বছর অক্ষতা প্রায় ২ কোটি পাউন্ড কর বাঁচান। এরপরই ঋষির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি গরিবদের থেকে কর নিচ্ছেন আর তাঁর স্ত্রী করই দেন না।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষঙ্গদের একাংশের মতে,তাঁর স্ত্রী অক্ষতার কারণেই ঋষি সুনাকের পরাজয়। তবে সমস্ত দোষ অক্ষতার উপর চাপিয়ে দিলে খুব ভুল করা হবে। ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি তাঁর সংস্থার বেশ কিছু শেয়ার স্ত্রীর নামে স্থানান্তর করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসেও অক্ষতার অংশীদারিত্ব রয়েছে। ওই সংস্থার অফিস রয়েছে রাশিয়াতেও। কিয়েভের উপর মস্কোর আগ্রাসনের পর রাশিয়া থেকে আয় হয় এমন ব্যবসাগুলি প্রশ্নের মুখে পড়ে। ঋষি ব্রিটেনের প্রথম সারির রাজনীতিবিদ হওয়ায়তাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে।তাছাড়াও কনজারভেটিভ দলের সদস্যরা অর্থসচিব হিসেবে সুনকের পারফরম্যান্সে খুশি নয়। উলটে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। অন্তত৮ শতাংশ সদস্য সুনকের করনীতিকে সমর্থন করেনি। অন্যদিকে ৫ শতাংশ সদস্যের মত, তাঁর কাছে পৌঁছনোবেশ কঠিন ছিল। সুনক ব্রিটেনের ‘ডিপ্রাইভড আরবান এরিয়াস’ ফান্ডের টাকাকড়ি কেন্ট কমিউটারস বেল্ট প্রকল্পে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা দলের একাংশ মেনে নেয়নি।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষঙ্গদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, নিজের স্বার্থে ঋষি সুনক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন। কেবল তাই নয়, বরিসের পদত্যাগেসবথেকে বড় ভূমিকা ছিল ঋষির। চ্যান্সেলর পদ থেকে সুনাক ইস্তফা দেওয়ার পরই বরিস সরকারের সাংসদরা নিজেদের পদ ছেড়েছিলেন। তারপরই বরিস সরকারের পতন ঘটে। এরপর থেকেইসুনাক কনজ়ারভেটিভ পার্টির সদস্যদের আস্থা হারান। যে কারণে অনেকেইতাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে চাননি।

অনেকের মতে সুনাকের হারের অন্যতম কারণ তাঁদের ইউএস গ্রিন কার্ড ধরে রাখা। চ্যান্সেলর হওয়ার পরও সুনাক ১৮ মাস গ্রিন কার্ড ধরে রেখেছিলেন। ২০২১ সালে আমেরিকায় তার প্রথম সরকারী সফরের সময়তিনি ওই কার্ড ছেড়ে দেন। ব্রিটেন দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি দিলেও, তাঁর আচরণ কনজারভেটিভ পার্টি সুনজরে দেখেনি। গ্রিন কার্ড থাকার কারণে সুনাকের ব্রিটেন নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ঘিরে যে প্রশ্ন ওঠে তাতে কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা তাঁকে ভোট দিতে নারাজ হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ঋষি সুনাক দু'বছর চান্সেলার এবং ১ বছর অন্য পদও সামলেছেন। চান্সেলার থাকাকালীন ব্রিটেনে বীমা সংক্রান্ত কর, আয়কর সবই বেড়েছে। এরপরও ২০২৩ এর মধ্যে কর্পোরেশন কর অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন। বিগত ৪৮ বছরে তিনিই প্রথম চান্সেলর যিনি এই ভাবে কর বাড়িয়েছেন। ব্রিটেনে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে দৈন্যদিন জীবনের খরচ বৃদ্ধি সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের একটা অভাব দেখা দেয়, যা নিয়ে গত কয়েকমাসে ব্রিটেনে একাধিকবার আন্দোলন হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চান্সেলর ঋষি সুনাক কোনও উদ্যোগ নেননি। বিরোধীদের অভিযোগ, ঋষি সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের থেকে অনেক দূরে থাকেন। শ্রমিক শ্রেণির মানুষের কষ্ট বোঝেন না। লক্ষ্যনীয়, অক্ষতার জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুনাকের কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। এর উপর অক্ষতা ভবিষ্যতে ভারতে এসে থাকতে চান জানানোর পরই ঋষি'র গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version