চিত্রশিল্পী ভেরোচিও তখন যিশুর ব্যাপ্টিজম নিয়ে একটি ছবি আঁকছিলেন। ছবির পরিকল্পনা- যিশু স্নান করছেন, তাঁর শরীরে জল ঢেলে দিচ্ছেন সাধু জন আর দেবদূতেরা যিশুর কাপড় ধরে আছে। অনেক দিন ধরে আঁকা ছবিটিতে জন আর যিশুর অংশের কাজ শেষ, বাকি কেবল দেবদূত আর প্রেক্ষাপট। বাকিটুকু তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে তরুণ শিক্ষানবিশকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি ফ্লোরেন্সের বাইরে যান। ফিরে এসে

স্টুডিওতে ঢুকে সেই ছবির সামনে এসে দাঁড়ালেন ভেরোচিও। তাঁর নজর কেড়ে নিল দেবদূত,অথচ ছবির নায়ক যিশু।ছবির বাঁ পাশের কাপড় ধরে রাখা এই দেবদূত তো ফ্রেমে ছিল না। আর এখন সেই দেবদূতের থেকে তিনি চোখ সরাতে পারছেন না । এ কী করে সম্ভব! এত নিখুঁত করেও ছবি আঁকা যায়?  এত বছর ধরে তিনি ছবি আঁকছেন জীবনে এখনও এত সুন্দর ছবি তো আঁকতে পারেননি। ভেরোচিও চিৎকার করে স্টুডিওর সবাইকে জড়ো করে ফেললেন। এরপর ২৩ বছরের তরুণ শিক্ষানবিশকে ডাকলেন- লিওনার্দো! শিক্ষানবিশ লিওনার্দো ধীর পায়ে হেঁটে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়ালেন।ভেরোচিও বললেন, তোমরা সবাই সাক্ষী থাকো, আমি আজকে থেকে আর কোনো দিন হাতে রঙ-তুলি ধরবো না। কোনো ছবিও আর আঁকব না, আমার জীবন সার্থক যে আমি লিওনার্দোর মতো চিত্রকরের শিক্ষক।  

শিল্পগুরু ভেরোচিওর কাছ থেকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান পেলেও তার পরের বছরই লিওনার্দোর জীবনে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। তাঁকে আরও কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে সমকামিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিপুল খ্যাতির এর একটি কারণ হতে পারে,তবে উপযুক্ত প্রমাণ কিংবা কোনো সাক্ষী যোগাড় না হলেও তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। জেল থেকে বেড়িয়ে লিওনার্দো ফ্লোরেন্সে নিজের স্টুডিও নির্মাণকরে কাজ শুরু করেন। যদিও বড় কাজ পেতে ৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়।প্রথম বড় কাজ পান চার্চের কাছ থেকে-  ‘Adoration of the Magi’। কিন্তু লিওনার্দো ছিলেন ভীষণ রকমের অলস। কোনো কাজ শুরু করলে তিনি সেটা শেষ করার কোনও তাগিদ অনুভব করতেন না। জীবনের প্রথম বড় কাজটি তিনি সারা জীবনেও শেষ করতে পারেন নি। এই ভাবে তাঁর বহু কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে।

ইতিমধ্যে সাক্ষীর অভাবে সমকামিতার মামলা প্রত্যাহার হয়ে যায়। লিওনার্দো ফ্লোরেন্স ত্যাগ করে মিলানে চলে যান। এটা তখনকার সময় শিল্পীদের অভ্যাস ছিল। ফ্লোরেন্স ত্যাগ করে তারা ভেনিস কিংবা রোমে কাজ করতে চলে যেতেন।‘অ্যাডোরেশন অফ দ্য ম্যাজাই’ শেষ না করার কোনো তাগিদ লিওনার্দো অনুভব করলেন না। কারণ তিনি মিলানের ডিউকের কাছ থেকে  একটি বড় প্রস্তাব পেয়েছিলেন।  যদিও সেই কাজ পেইন্টিং নয়,  তাঁকে ডিউক লুদোভিকো স্ফোরজার অধীনে বিশাল বিশাল নিত্যনতুন অস্ত্র বানানোর কাজ দেওয়া হয়। অবশ্য মিলানে থাকাকালীন লিওনার্দো দুটি বিখ্যাত ছবি আঁকেন। যার একটি ছিল ‘Virgin of the Rocks’, আর অন্যটি  ‘The Last Supper’

কিন্তু লিওনার্দো একদিন মিলান থেকে ফিরে এলেন নিজের শহর ফ্লোরেন্সে, তখন তিনি রীতিমত বিখ্যাত। ফ্লোরেন্সে এই সময় তিনি আঁকা শুরু করেন মানুষের পোট্রেইট। আর ফ্লোরেন্সের এই দিনগুলিতেই  তিনি আঁকেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত আর রহস্যময় ছবি- মোনালিসা।  The best known, the most visited, the most written about, the most sung about, the most parodied work of art in the world. মোনা ইতালীয় ভাষায় একটি ভদ্র সম্ভাষণ, Ma Donna (My Lady) এর শর্ট ফর্ম। আর লিসা তো তার নাম। সহজভাবে বলতে গেলে, ছবিটির নাম, ম্যাডাম লিসা।

মোনালিসার প্রেক্ষাপটে কী কী দেখা যায়, সেটি বিস্তর গবেষণার বিষয়। তবে মোনালিসা সম্পর্কে অন্য কথাও বলা হয়- মোনালিসা নাকি লিওনার্দোর ছদ্ম সেলফ পোর্ট্রেইট; আবার এমন কথাও শোনা যায় যে, এটা নাকি তার মায়ের ছবি! লিওনার্দোর মা সন্তানের ৫ বছর বয়সে ছেড়ে চলে যান। লিওনার্দো অনেক খুঁজেছেন তাঁর মাকে। তিনি কি খুঁজে পেয়েছিলেন মাকে? তার নোট বইয়ে চার বার ক্যাটেরিনার নাম দেখা যায়। প্রথম বার- 16 July/Caterina came, 16 July 1493। লিওনার্দো কেবল ‘ক্যাটেরিনা এসেছে’ এটুকুই লিখেছেন। ‘মা এসেছেন’ লেখেননি। হতে কি পারে যে, এটা তার মা ছিল? দু’বার কেন ‘১৬ জুলাই’ লিখলেন? ১৪৮২ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত লিওনার্দো  মিলানে ছিলেন।  ১৪৯৩ সালের ১৬ জুলাই মিলানেই তিনি এই ক্যাটেরিনা নামের নারীকে খুঁজে পান। সর্বশেষ তাঁর নোটে যে ক্যাটেরিনার উল্লেখ পাওয়া যায় সেটি হলো ক্যাটেরিনার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচের হিসাব। লিওনার্দোর নিজের হাতে Mirror Writing এ দেখুন সে হিসেব– beyond thirtynine। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি খরচ  হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, এই নারীর ব্যাপারে লিওনার্দো খুবই যত্নবান ছিলেন। তবে  ‘সম্ভবত’ কথাটা রেখে দিতেই হচ্ছে। মোনালিসার মতোই রহস্যের আড়ালেই রয়ে গিয়েছেন ইতালির রেনেসাঁর এই অগ্রপুরুষ। তার কোনো স্ত্রী কিংবা সন্তানও ছিল না, যে তার সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য দেবে। প্রসঙ্গত, মিরর রাইটিং জিনিসটি প্রথম করেছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি তার সকল নোট লিখে রাখতেন মিরর (আয়না) রাইটিংয়ে। কেন, কেউ জানে না। এমন নয় যে, এটা পড়া খুব কষ্ট; আয়নায় ধরলেই এই উল্টো লেখা সোজা হয়ে যায়। তবুও এমনটা করতেন তিনি। আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কিন্তু ছিলেন বাঁ-হাতি।

‘মিরর রাইটিং’ জিনিসটা প্রথম করেছিলেন দা ভিঞ্চি। তিনি তার সকল নোট লিখে রাখতেন মিরর (আয়না) রাইটিংয়ে। কেন, কেউ জানে না। এমন নয় যে, এটা পড়া খুব কষ্ট; আয়নায় ধরলেই এই উল্টো লেখা সোজা হয়ে যেতো। তবুও এমনটা করতেন তিনি। আরেকটি তথ্য, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কিন্তু ছিলেন বাঁ-হাতি।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version