জেলে বসে ‘The Tribune’ পত্রিকা পড়ছেন এক যুবক। রাত পেরলেই তাঁর ফাঁসি হবে। কিন্তু ওই পত্রিকার পাতায় লেনিনের ‘জীবন চরিত’-এর আলোচনাটি তিনি মন দিয়ে পড়তে পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ফাঁসির আগে তাঁকে বইটি পড়তেই হবে। অগত্যা জেলের ওয়ার্ডারের হাত দিয়ে আইনি পরামর্শদাতা বন্ধু প্রাননাথ মেহতার কাছে তিনি গোপন বার্তা পাঠালেন, “শেষ পরামর্শের অজুহাত দেখিয়ে এক্ষুনি এস। লেনিনের ‘জীবন চরিত’ বইটি আনতে ভুলবেনা”। ঘটনা ১৯৩১-এর ২৩ মার্চ সকাল, লাহোর জেলে। ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জন সাণ্ডার্সকে হত্যার অপরাধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন ভগত সিং, সুখদেব এবং রাজগুরু। ভগৎ সিং জানতেন তাঁর মৃত্যুর মুহূর্ত দ্রুত এগিয়ে আসছে। সূর্যাস্তের পরেই তাঁর ফাঁসি হবে। ইতিমধ্যে জেলে তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। যথাসময়ে প্রাননাথ ভগৎ সিং এর সেলে হাজির। ভগৎ সিং তাঁকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন “বইটা এনেছ”? প্রাননাথ ভগৎ এর হাতে ‘বিপ্লবী লেনিন’ বইটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভগৎ তুমি দেশের জন্য কিছু বলে যাও”। ভগৎ বইটি পড়তে পড়তেই মুখ না তুলে জবাব দিলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ মুর্দাবাদ। ইনকিলাব-জিন্দাবাদ’।

এরপর লাহোর সেন্ট্রাল জেলের চিফ ওয়ার্ডার চতুর সিং এসে ভগৎকে বললেন, ‘‘বেটা অব তো আখিরী ওয়াক্ত আ পঁহুছা হ্যায়। মেরা এক বাত মানলো”। ভগৎ হেসে বললেন, “বলুন, কি হুকুম?” চতুর সিং আন্তরিক ভাবে বললেন, “তোমাকে আমার একটাই অনুরোধ, এই অন্তিম সময়ে ‘বাহেগুরু’ কা নাম লে লো আউর গুরুবানী কা পাঠ করলো”। চতুর সিং-এর অনুরোধ শুনে ভগৎ হেসে বললেন “কিছুদিন আগে যদি আপনি আমাকে বলতেন, তাহলে আপনার ইচ্ছা আমি পূরন করতে পারতাম। এখন অন্তিম সময়ে যদি পরমাত্মাকে স্মরণ করি তাহলে তিনি এই কথাই বলবেন, ব্যাটা ভীরু! সারা জীবন আমাকে স্মরন করল না, এখন ফাঁসির দড়ি দেখে ভয় পেয়ে আমাকে ডাকছে। তার থেকে কি এটা ভালো হবে না, যেভাবে আমি এই জীবন কাটিয়েছি সেইভাবে দুনিয়া থেকে চলে যাই। একথা ঠিক যে কিছু লোক আমাকে নাস্তিক বলে কিন্তু আমাকে ভীরু বেইমান এ কথা তো কেউ বলতে পারবেনা”। চতুর সিং চলে গেলে ভগৎ আবার লেনিনের জীবনীতে মন দেন। তারপরেই সেলের তালা খুলে এসে দাঁড়ালেন জেলের কর্তা, বললেন, “সরদারজী, ফাঁসি লাগানে কা হুকুম আগেয়া হ্যায়।আপ তৈয়ার হো যাইয়ে”। ভগৎ হাতের ইশারায় তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে বইয়ের পাতাটি পড়া শেষ করে তেজদীপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ‘চলুন’। ইতিমধ্যে জেলের অন্য সেল থেকে এসে গিয়েছেন সুখদেব আর রাজগুরু। তাঁরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন।

ফাঁসির মঞ্চে ওঠার জন্য কালো পোষাক পরবার ব্যবস্থা হল। ভগৎ সিং বাধা দিয়ে বললেন, “ওই পোষাক আমরা পরব না। আমরা খুনে, ডাকাত বা অপরাধী নই। আমরা বিপ্লবী, রাজনৈতিক বন্দী”। খবর পেয়ে জেলের দারগা ছুটে এসে বিনীত অনুরোধ করলেন, “এটা নেহাতই জেলের প্রথা। একে এত গুরুত্ব দেবেন না”। একই ঘটনা ঘটলো হাতকড়া পরানো নিয়ে। শেষে সবিনয় অনুরোধ রাজী হলেন ওরা। তিন বন্দীকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হলে ভগৎ মৃদু হেঁসে অফিসারদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনারা সত্যিই খুব ভাগ্যবান কারন, আপনারা আজ এই দৃশ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছেন যে, ভারতীয় বিপ্লবীরা তাঁদের মহান আদর্শের জন্য কিভাবে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে”। এ কথা শুনে লজ্জায় অফিসারদের মাথা নীচু হল। ওঁদের গলায় ফাঁসির দড়ি পড়িয়ে দেওয়া হলে ভগৎ সিং হাত নেড়ে জেল সুপারকে অনুরোধ করলেন, দু মিনিট সময় দিন।যাতে আমরা জীবনের শেষ মুহূর্তে প্রান ভরে স্লোগান দিতে পারি। জেলসুপার মৌন থেকে সম্মতি জানালেন। তিন বিপ্লবী সর্বোচ্চ কন্ঠে স্লোগান দিলেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কা নাশ হো, Down with Imperialism!

অহিংসার পূজারী মহাত্মা গান্ধী চাইলে কি ভগৎ, সুখদেব আর রাজগুরুর ফাঁসি রুখে দিতে পারতেন? গান্ধী ভাইসরয় আরউইনকে চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু সেই চিঠির ভাষ্য যে গান্ধী তাঁর অহিংস পথের আদলেই লিখেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গান্ধী “তরুণ ভারতে” লিখেছেন, “আমি হয়তো বিষয়টি নিষ্পত্তি করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দণ্ড লঘু করার প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারতাম। কিন্তু এটি করা সম্ভব হত না। এ ব্যাপারে কার্যসভা আমার সাথে একমত পোষণ করেছে যে সাময়িক শান্তিচুক্তির নজির হিসেবে দণ্ড লঘু করার প্রস্তাব পেশ করা সঠিক হবে না। তাই আমি বিষয়টি কেবল উল্লেখই করতে পারতাম”। তার মানে গান্ধী যদি চাইতেন তাহলে দণ্ড লঘু করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করতে পারতেন। ভাইসরয় এর কাছে গান্ধী প্রার্থনা জানিয়ে বলেছিলেন, “ছেলেগুলোকে যদি ফাঁসি দিতেই হয়, তবে তা করাচির কংগ্রেস অধিবেশনের পরে না দিয়ে পূর্বেই যেন দেওয়া হয়”। তাই  ১৯৩১-এর কংগ্রেসের করাচী অধিবেশনে আওয়াজ ওঠে, গান্ধী গো ব্যাক, ডাউন উইথ গান্ধীইজম, লং লিভ্ ভগৎ সিং, “Gandhi’s truce has sent Bhagat Singh to the gallows”। ভগৎ সিং-এর সহ বিপ্লবী যশপাল, ঐতিহাসিক জিএস দেওল, এ জি নুরানিজ প্রমুখের মতানুযায়ী, ভগৎ সিং-এর ফাঁসির জন্য গান্ধী আন্তরিক ছিলেন না, বরং তিনি চেয়েছিলেন ভগতের ফাঁসি হোক তাতে আপামর জনসাধারণ ভগৎ সিং-এর পথে সশস্ত্র বিপ্লব তথা হিংসাত্মক আন্দোলন থেকে নিজেদের বিরত রাখবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version