সময়টা গেল শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি,  গায়ের জোরে পাকিস্তানের মসনদে তখন বসে আছেন জেনারেল জিয়াউল হক। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হটিয়ে ১৯৭৭ সালে তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তারপর থেকে এই সামরিক শাসক পাকিস্তানকে ইসলামীকরণ করার সবরকম উদ্যোগ নেন। সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ থেকে শুরু করে নাগরিক অধিকার খর্ব করতে একের পর এক কালাকানুন জারি করেন। পাকিস্তান থেকে হিন্দু সংস্কৃতি তথা ইসলামিক নয় এমন সব ধরনের সাংস্কৃতিক প্রভাব হটাতে তিনি ফরমান জারি করেন। এক ফরমান জারি করে তিনি মেয়েদের শাড়ি পরাও নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁর অভিমত শাড়ি ভারতীয় পোশাক। গর্জে উঠেছিলেন কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ।

ফয়েজের কবিতায় যেমন প্রেম আছে, আছে প্রতিবাদ, একইসঙ্গে মানবতাবাদী চিন্তা চেতনার স্পষ্ট প্রকাশ। ফয়েজের লেখা ‘ইয়েদাগ দাগ উজালে ইয়ে সবগুয়িতা শাহ্র’ (এই দাগ ভোরের আলো, রাতের খাপে ঢাকা এই ভোর) কবিতার জন্য ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় দণ্ডিত হন, যে মামলা ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিত। সেই মামলার বিচারে তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। জেলে ফয়েজ রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে লিখেছিলেন- ‘ফিকরে দিলদারিয়ে গুলযার কারুঁ ইয়া না কারুঁ/যিকরে মুরগানে গেরেফতার কারুঁ ইয়া না কারুঁ/কিসসায়ে সাযেশে আগইয়ার কাহুঁ ইয়া না কাহুঁ/শিকওয়াহে ইয়ারে তারহদার কারুঁ ইয়া না কারুঁ’ (পুষ্পোদ্যানের প্রশান্তি কল্পনা করব, নাকি করব না/বন্দী পাখির কথা বলব, নাকি বলব না/প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের কাহিনী বলব, নাকি বলব না/ পরমবন্ধুর নামে অনুযোগ করব, নাকি করব না’) জেলখানাতেই ফয়েজ লেখেন- ‘চেশমে নাম, জানে শুরিদা কাফি নাহিঁ/তোহমাতে ইশক পুশিদা কাফি নাহিঁ/আজ বাযার মেঁ পা বেজাওলাঁ চালো/ দাসতে ইফশাঁ চালো, মাস্তো রাকসাঁ চালো’ (ভেজা চোখ, অস্থির প্রাণ যথেষ্ট নয়/গোপন প্রেমের অপবাদ যথেষ্ট নয়/আজ বাজারে চঞ্চল পায়ে চলো/হাত নাচিয়ে চলো, মত্ততা ও নৃত্যতালে চল)

১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীকে ধিক্কার জানিয়ে ফয়েজ আহমেদ কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতায় পাকবাহিনীর প্রতি তাঁর তীব্র নিন্দা প্রকাশ পায়। পাকবাহিনী ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে টিক্কা খাঁনের নির্দেশে ঢাকায় নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা শুরু করলে মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা এই কবি লিখিতাকারে পাকিস্তান সরকারের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানিয়েছিলেন। গণহত্যার কথা স্মরণ করে তার ‘হাজার কারো মেরে তান সে’ (আমার শরীর থেকে দূরে থাক) কবিতাটি লিখেছিলেন।

গণমানুষের কবি ফয়েজ ছিলেন নিপীড়িত ও শোষিতের পক্ষে। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালবাসা। ভাষা ও ভূগোলের সীমানা ভেদ করে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ হয়ে উঠেছেন সব দেশ ও মানুষের কবি। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে তাঁর কবিতা রুশ ভাষায় অনূদিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। পরে ফয়েজের কবিতা সমগ্র রুশ ভাষায় অনূদিত এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু বিভাগের পাঠ্যসূচিতে ফয়েজের কবিতা অন্তর্ভুক্ত ছিল বহুদিন। কবিতার পাশাপাশি ফয়েজ ছিলেন সাংবাদিক, ফয়েজের খ্যাতি ছিল চলচ্চিত্রকার ও সুফিদর্শনের একজন কট্টর অনুরাগী হিসেবে। প্রথম ছবি ‘জাগো হুয়া সাত্তয়েরা’(জেগে ওঠো ভোর হয়েছে)। এই ছবিতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক বিষয় তুলে ধরেছিলেন সে দেশের একজন দরিদ্র মৎসজীবীর জীবন সংগ্রামের কাহিনীর মধু দিয়ে। ছবিটি পাকিস্তানের মৌলবাদী সরকার নিষিদ্ধ করলেও পরবর্তীতে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্নপদক লাভ করে। ২০০৭ সালে প্যারিস চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি দেখানো হয়েছিল। সুফি দর্শনে আস্থাশীল ফয়েজের সঙ্গে বাবা মালাঙ সাহেব, ওয়াসিফ আলি ওয়াসিফ, আসফাক আহমেদ, সৈয়দ ফখরুদ্দিন প্রমুখের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘দে (সুফি) আর রিয়াল কমরেডস’।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে ফয়েজ বৈরুত গিয়েছিলেন। সেই সময়ে জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন। ইসলামীকরণের নামে জিয়া পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছিলেন। ফয়েজ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন- ‘হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে/লাযেম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে/ওহ দিন কে জিস কা ওয়াদা হ্যায়/জো লৌহে আযাল মেঁ লেখা হ্যায়/জাব যুলমো সেতাম কে কোহে গেরাঁ/রুয়ি কী তারাহ উড় জায়েঁঙ্গে’ (আমরা দেখে নেবো, আমরা দেখে নেবো/অবশ্যই আমরাও দেখে নেবো/আমরা দেখব প্রতিশ্রুত দিন/যা লেখা আছে চূড়ান্ত ভাগ্যলিপিতে/যেদিন অন্যায় অত্যাচারের সুদৃঢ় পাহাড়/তুলার মতো উড়ে যাবে)  

ফয়েজের মৃত্যুর বছর দুই পর লাহোরের আল হামরা আর্ট হলে চলছে ফয়েজ উৎসবে জিয়া উল হকের ফরমান উপেক্ষা করে শাড়ি পরে গান গাইতে এলেন পাকিস্তানের প্রবাদপ্রতিম গজল ও ঠুমরী গায়িকা ইকবাল বানু। যদিও তাঁর জন্ম দিল্লিতে, দেশভাগের পাঁচ বছর পর বিবাহসূত্রে তিনি পাকিস্তানি হয়েছিলে। প্রতিবাদের রং কালো শাড়ি পরে হলভর্তি দর্শকের সামনে এসে ইকবাল বানু গেয়ে উঠলেন, ‘হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে… করতালিতে ফেটে পড়ল গোটা হল! গানের মাঝে বারবার থামতে বাধ্য হলেন ইকবাল বানু, কারণ হল কাঁপিয়ে শ্রোতারা স্লোগান দিলেন, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। স্বভাবতই জিয়া উল হক এটা মেনে নিটে পারেন নি।সেই রাতে লাহোরের শিল্পী-সাহিত্যিকদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী, ধ্বংস করেছিল সেই গানের রেকর্ড। তবু সেই গান ফিরে এসেছে ভারতে ছাত্র আন্দোলনের কণ্ঠস্বর হয়ে, এই প্রজন্মের তরুণদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version