বাংলার মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। তার আভাষ মিলেছিল লোকসভা ভোটে। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে বামেরা পেয়েছিল মাত্র ১৫টি আসন। অন্যদিকে বামেরাও ধরে নিয়েছিল যে, এবার নেভার। দেশের প্রায় সবকটি এক্সিট পোল ইঙ্গিত করেছিল পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ইতিমধ্যে বাংলায় তৃণমূলকংগ্রেস ক্রমশই তার শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে। তখন তৃণমূলের সঙ্গী ছিল কংগ্রেস। কলকাতা ও শহরতলীতে বামেদের শক্তিক্ষয় ঘটেছিল অনেক আগেই। দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুরে কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি হয়। পরবর্তীতে কলকাতা পুরসভা সহ অন্যান্য পৌরসভাগুলি থেকেও বামেরা উৎখাত হতে থাকে। এরপর ২০১১-র বিধানসভার ভোট।তৃণমূল-কংগ্রেস জোট বাংলায় ২৩১টি আসন জয় করে নেয়।মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তাঁর মন্ত্রীসভার ২৭ জন মন্ত্রী পরাজিত হন।

ঠিক ১১ বছর আগে পরিবর্তনের ঝড়ে ৩৪ বছরের বাম শাসন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়েছিল। বাংলার মানুষ চেয়েছিল বলেই বাংলায় বামেদের বিরুদ্ধে চাপা বিক্ষোভ বিধ্বংসী কালবৈশাখীর আকার নিয়েছিল। মমতা ঝড় আছড়ে পড়েছিল ইভিএমের বোতামে। প্রশ্ন, এই বাংলার যে আপামর মানুষ সেদিন পরিবর্তন চেয়েছিল এবং যাদের তীব্র বাম বিরোধীতার কারণে সেদিন বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটেছিল আজ ১১ বছর কেমনপরিবর্তন দেখছেন তাঁরা? বাংলার মানুষের রায়েই তৃতীয়বারেও বিপুল ভোটে জিতে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলা শাসন করছে।বাংলায় বামেরা আজ শূন্যস্থানে, তৃণমূলের সেদিনে জোটসঙ্গী কংগ্রেসও শূন্য। বিরোধী আসনে আজ নতুন শক্তিবিজেপি। ২০১৯-এর লোকসভায় আশা জাগিয়েছিল কিন্তু একুশের বিধানসভায় ধুয়ে মুছে সাফ। পরবর্তীতে যেকটি ভোট হয়েছে বিজেপিকে পিছনে ফেলে বামেরা এগিয়ে এসেছে।তাতে বামেদের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে একথা বলা যাবে না। তবে তৃণমূল একক শক্তিতে বলবান হয়ে চলেছে।তারা আজ বিরোধীহীনও বটে। এতে নতুন এক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে কারণ আজ ক্ষমতা নিয়ে তৃণমূল নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষে লিপ্ত!

রাজনৈতিক পরিবর্তনে বামেরা ক্ষয়ে যেতে যেতে এখন চলটা ওঠা ভাঙা পাঁচিলের দেওয়াল লিখন। বিধানসভাতেও শূণ্য আসন, মাঝে মধ্যে মিছিল মিটিং করে ফিনিক্সের মতো বেঁচে ওঠার বিফল চেষ্টা। বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে, বিজেপির জমানত জব্দ করে সঞ্জিবনী সুধা আনার ব্যর্থ প্রয়াস। অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেস কেবল বিধানসভাতেই শুন্য নয়, তৃণমূলকে ক্ষমতায় এনেরাজ্য থেকে প্রায় নির্বাসনে চলে গিয়েছে। অধীর চৌধুরী, প্রদীপ ভট্টাচার্য, আব্দুল মান্নান এই ধরণের নেতা ছাড়া প্রায় সবার হাতেই ঘাসফুল। গেরুয়া শিবিরেরও এখনপ্রায় কোনও জেলাতেই সেরকম সংগঠন নেই। আগামী দিন এ রাজ্য যে তারা কিছু করে উঠতে পারবে সে আশা তারা নিজেরাও করে না। ফলে রাজনৈতিক ভাবেবাংলায় এখনও তৃণমূল অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং এই রাজ্যে তাদের কোনও আশু বিপদেরও সম্ভাবনা নেই।শুধু বাংলার মানুষের রায়ে তিন-তিনবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাওয়া তৃণমূল নেতাদের নিয়েই সমস্যায় জর্জরিত ঘাসফুল শিবির। ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত দুর্নীতি আর কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ায়নি এমন একজন তৃণমূল নেতা মন্ত্রীর নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিগত ১১ বছরে তৃণমূল জমানায় একের পর এক ঘটেছে সারদা, রোজভ্যালি, নারদা, কাটমানি, সিন্ডিকেট, সরকারি প্রকল্পের টাকা চুরি, নিয়োগে ইধার উধারের মতো দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি আর তার প্রত্যেকটিতে জড়িয়ে আছে শুধুমাত্রতৃণমূল নেতা ও মন্ত্রীদের নাম।

ক্ষমতায় এসেই ছুটকো ছাটকা ঘাসফুল নেতারাও কখনো পুলিশ পিটিয়ে, কখনও কলেজের প্রিন্সিপালের গালে চড় মেরে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। বীর পুঙ্গবরা তখনই জানিয়ে দিয়েছিলেন, আভি বহুত কুছ বাকি হ্যায়, খেল দেখতে রহো। বঙ্গবাসী তখন বোঝেননি তাই এখন কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে শোনেন, সারদা কান্ডে নাম জড়িয়ে দিনের পর দিন জেল হেফাজতে থেকে, জামিন পাওয়া তৃণমূলের নির্ভরযোগ্য নেতাদের কেউ করেন রঙ্গ-তামাশা,কেউ দলীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে বাণী প্রদান করেন। মনে মনে বঙ্গবাসী তাদের বেহায়াপনা আর নির্লজ্জতা দেখে অবাক হলেও সেই নেতারা কিন্তু বলে দিয়েছেন, দেখতে রহো, আভি বহুত রিল বাকি হ্যায়। চিট ফান্ড কান্ডে ফেঁসে জেল হেফাজতে থেকে, জামিন পেয়েছেন যারা তারা সবাই তৃণমূলের বলিষ্ঠ নেতা। নারদা কেসে ফেঁসে বারবার সিবিআই এর জেরার মুখে পড়েছেন, এমনকি গ্রেফতার হয়েছেন তারাও সবাই তৃণমূলের মন্ত্রী। নানা ধরণের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন যারা তারাও তৃণমূলের খোকা নেতা। শুধু কি তাই, স্বয়ং দিদিকেও নাজেহাল হতে হয় ভাইপো ও ভাইদের কীর্তিকলাপে, দিদির একার চোয়ালচাপা লড়াইতে যা চাপা পরে যাচ্ছে।কিন্তু আর কতদিন পরিবর্তনের ধ্বজাধারীরা গ্রামে গ্রামে নিজেদের কুঁড়েঘরগুলিকে রাজপ্রাসাদ বানাতে পারবেন?

তাহলে কোথায় কি পরিবর্তন হল- এখনো পাড়ায় পাড়ায় নেতাদের দাদাগিরি নিয়ে অভিযোগ রয়েই গিয়েছে,যেমন ছিল বাম আমলে। নিজের জমিতে বাড়ি তৈরি করতে গেলে লাল ধ্বজাধারীদের যেমন প্রণামী দিতে হত, ঘাসফুল বাহিনীকেও সার্ভিস ট্যাক্সদিতে হয়। নিজের পয়সায় ফ্লাট কিনতে গেলেও পাড়ার লাল থেকে সবুজ হওয়া ক্লাবকে মোটা চাঁদা দিতে হয়। বাজারে গিয়ে কোনও জিনিদের দাম জিঙ্গাসা করলেই সাধারণ মানুষের পকেটে ছ্যাকা লাগে। সব দোষ কেন্দ্রের এই শ্লোগান বাম আমলেও ছিল এখনও চিৎকার করে বলা হচ্ছে। তখনও কেন্দ্রের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানো হত এখনো সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। বাজারের টাস্ক ফোর্স দাম নিয়ন্ত্রণে কী করছে কেউ কি জানেন? অবশ্যই না। পেট্রোল ডিজেলের উপর কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যও গুচ্ছের ট্যাক্স চাপিয়েছে। নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্তের।

তবু বেঁফাস মন্তব্য করে হাসির খোরাক হয়েও তিনি একের পর এক ভোটে বাজিমাত করছেন।শিক্ষিত তথা বুদ্ধিজীবীদের হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ বানিয়ে রেখেছেন।কিভাবে? উত্তরবঙ্গে আলাদা সচিবালয়, কলকাতাকে জেলায় নিয়ে গিয়ে জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কড়া নজর, দু’টাকা কেজির চাল, সবুজ সাথীর সাইকেল, কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার- স্রেফ এই ভরসায়?
Share.

2 Comments

  1. আরও হাত খুলে লেখা যেত, পড়তে ভাল লাগছিল। বিকল্পের objective reality থাকা স্বত্বেও গড়ে ওঠার কোনও তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটা বিপজ্জনক।

  2. suchikkhan das on

    ১১ বছরে গ্রাম আর শহরে যে উন্নয়ন ঘটেছে সেই পরিবর্তন লেখকের চোখে পড়েনি, বাম জমানায় যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল গত ১১ বছরে তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

Leave A Reply

Exit mobile version