এ দেশে ফিবছর এপ্রিল-মে মাসে দাবদাহের ঘটনা একরকম গা সওয়া। কিন্তু এ বছর মার্চ মাস থেকেইহিমাচলসহ ১৫টি রাজ্যেরতাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ(আইএমডি) জানায়,দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের ৫টি রাজ্যের কিছু অংশে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর,যা ১২২ বছরের মধ্যে রেকর্ড গড়েছে। চলতি মে মাসেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি।এ বছর মার্চ মাসের গড় তাপমাত্রা ৩৩.০৯ ডিক্রি সেলসিয়াস। যা ২০১০ সালের মে মাসের গড় তাপমাত্রা ৩৩.১ ডিক্রি সেলসিয়াসকে ভেঙে দিয়েছে।

ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ট্রপিকাল মেটিওরোলজি এই দাবদাহের পেছনে আবহাওয়াগত কয়েকটি কারণ ছাড়াও উষ্ণতা বৃদ্ধিকেও একটি বড় কারণ বলে মনে করছে। অন্যদিকে ইন্সটিটিউট ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ স্টাডিজের বক্তব্য, কংক্রিটের রাস্তা আর বাড়ির সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ায় তাপ আটকা পড়ে দাবদাহের মাত্রা যেমন বাড়াচ্ছে পাশাপাশি বন উজাড় করার মতো ঘটনাকেও দায়ী করছে।

ভারতীয় আবহ বিজ্ঞানীরা দেশের তাপপ্রবাহকে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ বলে ব্যাখ্যা করছেন। তাদের মতে, এ বছর তাপদাহ আগের বছরগুলির থেকে বেশি হলেও আগামী বছরগুলিতে তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে যা গ্রীষ্মকালে মানুষের জীবন ধারণের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠবে। এ বছর আবহাওয়া বিভাগ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তাপমাত্রা রেকর্ড শুরুর পর থেকেই দেখা যায় এপ্রিল মাসেই তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি। উত্তর ভারতের বিশাল অংশ জুড়ে মার্চ মাস্র মাঝামাঝি থেকেই তাপদাহ শুরু হয়ে যায়। এরপর মে মাসের শুরুতে কিছুটা বৃষ্টির কারণে তাপদাহের যন্ত্রণা কিছুটা কমলেও পরবর্তী সময়ে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়।

যদিও দেখা যায় তাপপ্রবাহে দেশের গরিব মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি কষ্টের শিকার,তবে সমাজের কোনো অংশই তাপপ্রবাহের হাত থেকে নিস্তার পায় না। দেশের বড় বড় শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও হাইরাইজ বাড়ির সংখ্যা বেশি থাকায় সেখানকার বাসিন্দারাও কষ্ট পান। এখানকার উচ্চবিত্ত মানুষ শীত হতেই বাড়ির এয়ারকন্ডিশনারগুলি চালু করে দেন।সেই মেশিনগুলি থেকে নির্গত গরম হাওয়া পরিবেশকে উষ্ণ করে তোলে। শিশুরা তুলনামূলকভাবে শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল,এখানকার অনেক অভিভাবক স্কুল বন্ধ রাখা বা ক্লাসের সময়সূচি বদলের দাবি করেন। 

এ বছর দেশের কোটি কোটি মানুষ অস্বাভাবিক তাপদাহের শিকার হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন গরম শুধু মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে তো বটেই, প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান, কৃষি, জল সরবরাহ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ-সহ অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাতে ধারাবাহিক ক্ষতি সৃষ্টি করে চলেছে। এই সময় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশে প্রচণ্ড জ্বালানি সংকট সৃষ্টি হয়। বিপুল জমির গম সহ নানা ফসলনষ্ট হয়; যে কারণেফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরন হয়না। বিজ্ঞানীরা দেশের এই তাপপ্রবাহ চরম হওয়ার জন্য সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন।

আইএমডির তথ্য অনুসারে, গত ২৭ এপ্রিল নাগাদ গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস, গত পাঁচ বছরের তুলনায় যা ছিল সবচেয়ে বেশি।১৯৫১ সালের পর এ বছর মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও গুজরাটে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রা ছিল বেশি। একই অবস্থা দিল্লি, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশে। এই সব রাজ্যগুলির বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা ছিল লাগাতার ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে। অস্বাভাবিক গরমের শিকার হয়েছে তুলনামূলক ঠাণ্ডা অঞ্চল- হিমাচল প্রদেশ। এছাড়ামধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার কিছু এলাকায় অস্বাভাবিক গরমে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের অধিকাংশ এলাকায় তাপমাত্রা হয়েছে ৪৩-৪৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। একই দশা ছিল- উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল, গুজরাটের কিছু এলাকা, উড়িষ্যার প্রত্যন্ত কিছু এলাকা এবং মধ্য মহারাষ্ট্র এবং বিহারের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় সমভূমি গঠিত কিছু জেলায়। ৪০-৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল হরিয়ানা-দিল্লি, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা, চত্তিশগড়, মারাঠাওয়াড়া, তেলেঙ্গানা এবং রায়ালাসিমায়।পুরো ভারতজুড়ে মার্চের গড় তাপমাত্রা ছিল সাধারণের চেয়ে ১.৮৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি।

আইএমডির বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে তাপদাহে গত ৫০ বছরে ভারতে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।জলবায়ু বিজ্ঞানীদের মত, গোটা বিশ্বের উষ্ণতার কারণে দেশে চরম তাপদাহ সৃষ্টি হয়েছে এবং এ ধরনের চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া আগামী দিনে আরও বাড়বে।১৯ শতকের তুলনায় তাপদাহ অন্তত ৩০ গুণ বেড়েছে, কারণ পৃথিবীকে উষ্ণ করে এমন গ্যাসের নিঃসরণ আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে গোটা বিশ্ব গত শতকের শেষ দিকের তুলনায় ১ দশমিক ১ ডিগ্র সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হয়ে পড়েছে।বিজ্ঞানীরা মার্চ ও এপ্রিলের প্রতিদিনকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখে তাদের ধারণা, উষ্ণায়ন শুরুর আগের তুলনায় এখন তাপদাহের সম্ভাবনা ৩০ গুণেরও বেশি হতে পারে।

তাপদাহ এই হারে বৃদ্ধির কারণ গোটা বিশ্বের উষ্ণায়ন চক্র। যে কারণে উষ্ণতা পৃথিবীতে আটকে থাকছে, গ্রিন হাউজ গ্যাসসূর্যালোক থেকেও আরও বেশি উষ্ণতা শুষে পৃথিবীকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। যাকে ‘হিট ট্র্যাপ’ বলা হয়। ভারতের উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের অভাবই তাপদাহের প্রধান কারণ। সাধারণত এ সময়ের উচ্চ তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে দিনকয়েকের বৃষ্টিপাত। কিন্তুএ বছরের মার্চ ও এপ্রিলে বৃষ্টি সেভাবে হয়নি বললেই চলে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের পর সবচেয়ে প্রবল বর্ষণের ঘটনা কিন্তু এপ্রিলেই হয়েছে। যদিও তার বেশিরভাগ হয়েছে দক্ষিণ ও উত্তরপূর্ব ভারতে। মূলত বিশ্বের উত্তরতম প্রান্তে তাপমাত্রার ফলে সৃষ্ট নিম্নচাপ ভারতে বৃষ্টিবাহক মেঘ বয়ে আনে, যা দ্রাঘিমাংশ অতিক্রম করে মধ্য এশিয়া হয়ে ভারতে আসে। তবে নিম্নচাপ দুর্বল হলে বৃষ্টিও কম হয়। এবছরের মার্চ ও এপ্রিলে প্রশান্ত মহাসাগরে সাধারণের চেয়ে শীতল পরিস্থিতির কারণে নিম্নচাপ কমেছে এবং তা ভারতে বৃষ্টিপাতের জন্য সহায়ক হয়নি।
Share.

1 Comment

  1. ভাল প্রতিবেদন। গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি কৃষিক্ষেত্রে পোকা -মাকরের আক্রমন বাড়াবে , মেরুপ্রদেশের বরফ গলিয়ে সমুদ্রের জলস্তর বাড়াবে। ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি । ফলতঃ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ‍্যা বৃদ্ধি, ম‍্যাঙ্গ্রোভ ধ্বংস, অনেক সহর জল প্লাবিত হবে। সম্ভাব‍্য ক্ষতির তালাকা আর ও অনেক দীর্ঘ।?

Leave A Reply

Exit mobile version