সুবর্ণপ্রতিম গিরি

জানেন, আমাদের একটা রোগ আছে প্রায় সবারই। না ঠকলে সেটাকে রোগ বলে মনে হয় না, মনে হয় ক্রেডিট। মনে হয়, এই তো পড়শিরা যা পারেনি আমি পেরেছি। নিজের বিবেচনা, নিজের বুদ্ধির, নিজের চোখের তারিফ করি। রোগটা হল ‘মানুষ চেনা’। মানুষ শত ক্রোশ দূরে থেকেও পাশে থাকে, আবার হাতে হাত রেখেও বিশ্বাস ভাঙে। মানুষ গভীর ভালোবাসাও গোপন রাখে, আবার প্রতারণার ইচ্ছা নিয়েও অকপটে বলে দেয় ভালোবাসি। মানুষ থাকবো বলেও হারিয়ে যায়, চলে যাচ্ছি বলেও বারবার পিছু ফিরে তাকায়। জীবনের বিভিন্ন ধাপে প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে জড়াই। কিছু কিছু সম্পর্ক জীবনের সম্পদ হয়ে থাকে। আবার কিছু সম্পর্ক দিনশেষে ঠকায়, রেখে যায় অবিশ্বাস আর মানসিক ট্রমা। অনেককেই আফসোস করে বলতে শোনা যায়, ‘ইশশ, লোকটা যে এমন, যদি আগে বুঝতাম!’

আসলে যতক্ষণ না ভুল প্রমাণিত হই, ততোক্ষণ কী দাপট। বুক ঠুকে সবাইকে বলে বেড়াতে ইচ্ছে করে, এই দ্যাখ, আমি ঠিক লোককেই চিনেছি। যে লোকটা একটা সময় পর্যন্ত আমার লোক চেনার ক্ষমতাকে ‘প্রমাণিত’ করে সেই লোকটাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়, তাকে গোছাতে, বাগাতে, স্নেহ করতে, ভালোবাসতে, আগলে রাখতে ইচ্ছা করে। করে তো? এটা দোষের নয়। এটাই তো হওয়া উচিৎ। আমরা তো কেউ আবেগ বর্জিত জীব নই। কিন্তু ভুললে চলবে না, আমার ঠিক চেনাটা কষ্টি পাথরে যাচাই হলে ফলাফল বিগড়ে যেতে পারে। অনেক হ্যাঁ না হতে পারে, আবার অনেক না হ্যাঁ হতে পারে। তখনই অনিবার্যভাবে মনে যে প্রশ্নটা আসবে, আমি কি লোক চিনতে ভুল করেছিলাম? এই প্রশ্নটা নিজেকে করার সময় যদি চোখ ছলছল করে ওঠে, তাহলে উত্তরটা হচ্ছে, তুমি লোক চিনতে ভুল তো করেইছো, লোকটাও ভুল ছিল। এই সব চেনা অচেনার মাঝে আমাদের করণীয় কী? করণীয় একটাই, আবার ঠিক মানুষকে ঠিক করে চেনার খেলায় নেমে পড়া, ঠিক আগের মতোই। রেজাল্ট?

রূপসা, বৃতি, কণিকা, শিউলি, বর্ষা, মনীষা, দীপিকারা। এরা কারা? এরা আগামী দিনের তারকা। নাচে-নাটকেযন্ত্রে-গানে। এই কথাগুলো বলা মানেই তো সেই বৃত্তের শুরুতে এসে দাঁড়ানো। সেই মানুষ চেনার গল্প। ইদানিং আমার এক অদ্ভুত রোগ দেখা দিয়েছে। অচেনার মধ্যে চেনা খুঁজে বেড়ানো। শুরুটা যে কবে শুরু হয়েছিল তা মনে নেই। তবে বছর পাঁচেক তো হবেই। এই রকমভাবে পথে ঘাটে কতজনকে ছোটবেলার বন্ধু, একসাথে পড়া বান্ধবী মনে হয় তার ইয়ত্তা নেই। শুধু মনে হওয়া হলে তাও কথা ছিল, কথা বলে কৌতুহল নিরসনের এক অদম্য ছটফটানি মনের মধ্যে শুরু হয়। ফলস্বরূপ হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, ঘামতে শুরু করি, অসুস্থ বোধকরি। বুঝতে পারি এটা একরকম অসুখই, তবুও…। এই সব স্মৃতি বা পুরোনো লোকজনকে মনে পড়া সাধারনতঃ বয়স হলেই শুরু হয়। প্রথম প্রথম ভাবতাম সেরকমই কিছু একটা। কাল কী ভাবে বাড়ি ফিরেছি মনে করতে পারি না। কিন্তু ছোটোবেলায় ক্লাস নাইনের পরীক্ষার সময় অঙ্ক পরীক্ষার দিন জ্যামিতির পঁচিশ নম্বর না করে খাতা জমা দিয়েছিলাম, সে কথা এমনভাবে মনে পড়ে যেন গত মাসেই ঘটেছে। কেন যে এমন হয় কে জানে! একবার ভেবেছিলাম সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবো। কিন্তু গড়পরতা দশজনের মতো ‘পাছে জানাজানি হয়ে গেলে লোকে পাগল ভাবে’ এই ভাবনায় চুপ করে গিয়েছি। ব্যাপারটা হয়তো লিখতে হত না, যদি না মল্লিকা এ ভাবে দাগা না দিয়ে যেত। মল্লিকার সঙ্গে আমার ভাব ভালোবাসা ছিল না। সে নাচের ক্ষেত্রে নাকি গুরুঅন্ত প্রাণ ছিল। ছিল কি না বলা যায় না, তার গুরু অন্তত তাই বিশ্বাস করত। পায়ে বোল ফুটিয়ে একদিন নাকি সে একেবারে সবাইকে ছাপিয়ে একক হবে। এগুলি ছিল বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস ধাক্কা খেল একেবারে আমফানের মতো। আর তাতেই মানুষ চেনা বা না চেনার প্রশ্নটা সামনে এল। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে শত শত প্রাণ, তৃণ, উদ্ভিদ সবাই চেনা-না চেনার চলার পথের সঙ্গী। বাড়ির সামনের ঝাঁকড়া কামরাঙ্গা গাছের ছোট ছোট লাল ফুল, গাছে বসা চড়ুই, টিয়া কোনও না কোনও ভাবে মানুষের মননে চিহ্ন এঁকে দেয়। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ, চিৎকার, হাসি-কান্না, প্রাকৃতিক দোলাচল সবকিছুকে অবিকৃতভাবে মানব-মস্তিষ্ক খাতায় লিখে নেয়। ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আবার একজন মানুষ অন্যজনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠার সময় থেকে অন্য একজন ব্যক্তির সান্নিধ্যে মানুষকে পরিপূর্ণতা দেয়। খাদ্য থেকে শুরু করে জিনগত অভ্যাস, বৈশিষ্ট্য, রোগবালাই অনেক কিছুই মানব-শিশু মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে।

এই যে সম্পর্কের গভীরতার সুতো এটা এক ধরনের বিষয়। কিন্তু যখন সে শিশু বড় হতে থাকে চারপাশের অন্য সম্পর্কগুলি তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, ব্যক্তিত্ব তৈরিতে সহায়তা করে থাকে। সেখানে কাকে কী ভাবে চিনছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক সময় আমরা পরিচিতদের থেকে দূরে সরে যাই সময়ের প্রয়োজনে, জীবনের প্রয়োজনে। এ বিচ্ছেদ ইচ্ছাকৃত নয়, বহমান। শৈশবের, যৌবনের শ্যামলকান্তি মুখ, প্রিয় বন্ধু, আপনজন দূরে সরে যায়। জীবনের অভিঘাতে তাকে ভুলে যাই আস্তে আস্তে। আবার যখন যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই সেই মুহূর্তগুলো মিহিদানা বরফকুচির মতো বিশেষ হয়ে ওঠে, যার ব্যাপ্তি মানসিক জগৎকে পূর্ণতা দেয়। প্রত্যেক আলাদা মানুষ ভিন্ন ভিন্ন একজনের ভেতর বেঁচে থাকে। আমরা প্রত্যেকেই প্লুরাল পার্সোনালিটির অধিকারী। আমরা একক কোনও সত্তা নই শুধু। প্রিয় বন্ধু, ভাই-বোন, খেলার সাথি, সহপাঠী, সহকর্মী, মিছিলের বন্ধু প্রত্যেকের আলাদা চেহারায় আমরা দোল খেতে খেতে এগোই। আর সেই চলনে যাকে নিজের মতো করে গড়তে চেয়েছি অবোধের মতো, সে ভিন রাস্তা বেছে নিলে ভাবনার সঙ্কটে এসে হাজির হই। মনে হয়, আমার চেনা এত ভুল হয়। ভুলটা কী আমার, নাকি যে ছেড়ে চলে গেল?

এ ক্ষেত্রে আমার বাবার দেওয়া সেই উদাহরণটাই দিতে চাই। এক শিক্ষকের হাতে তৈরি দুই প্রতিভাবানের গল্প। শচীন ও কাম্বলি। একসঙ্গে দুই বিস্ময় প্রতিভা। একজন ক্রিকেটের ভগবান হয়ে গেলেন গুরুর দেখানো পথে হেঁটে, অন্যজন বখাটে প্রতিভা হয়েই থেকে গেলেন। বাবা বলেন, এই ভেদাভেদের কারণ হল শিক্ষা, বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ। শিক্ষকের শিক্ষা গ্রহণের জন্যও শিক্ষা থাকতে হয়। সবার পেটে ঘি ভাত সহ্য হয় না। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটা একটা লোকপ্রবাদ। প্রবাদ তো আর হাওয়ায় ভেসে আসেনি। প্রবাদ তৈরি হয়, সমাজের অভিজ্ঞতায়। তাহলে প্রশ্ন, সবার ঠিকুজি দেখবো কী করে মানুষকে বিচার করার ক্ষেত্রে। আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, গড়গড় করে এই যে নামগুলো বললেন, এদের সবটা আপনি জানেন? চিনতে ভুল হচ্ছে না তো? আমি নিরুত্তর। জানি না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি এরা আর যাই হোক, খুব সরল। এদের ভাসা চোখ বলে দেয়, এরা ভালোবাসার মর্যাদা দিতে জানে, মানীর মান রাখতে জানে, স্নেহের আদর খেতেও জানে, আবার চরম অনুশাসনে মানানসই। এগুলো না জানলেও এরা বিনয়ী। এরা অকৃতজ্ঞ নয়। এরা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখতে জানে। তাই এদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। মানে আমি আগামীতে হয়তো ভুল প্রমাণিত হতে পারি, কিন্তু আমি তাতে ভয় পাই না। কারণ ভুল প্রমাণিত হওয়াটাও তো একটা কঠিন, বাস্তব শিক্ষা।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version