কৌশিক সরকার

আমার ছেলের বয়স তখন পাঁচ কি বড়জোর ছয় বছর। গ্রীষ্মের এক বিকেলে বাবা-মা দুজনকেই সামনে পেয়ে সে আমায় জিজ্ঞাসা করলো বাবা, মায়ের দুদুগুলো বড় বড়, তোমারগুলো এত ছোট ছোট কেন ? কোলে বসা ছেলের মুখের দিকে একবার তাকালাম। নিষ্পাপ মুখটিও চেয়ে আছে আমারই মুখের দিকে। তার প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়। তারপর তাকালাম ওর মায়ের দিকে। তার মুখ যেন লজ্জায় লাল।
গল্পটা বলছিলাম আমার এক মহিলা বন্ধুকে। তার মেয়েও আমার ছেলের প্রায় সমবয়সী। ও বললো, আমার মেয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করেছে মা, মেয়েরা বসে হিসু করে, ছেলেরা দাঁড়িয়ে করে কেন?ও বললো, আমি ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তুই কোথায় দেখলি? ও বললো, কেন বাবাকেই তো দেখেছি।

পাঁচ বছরের ছেলের ওই প্রশ্ন শুনে আমার বউ তো বেশ খানিকটা বিব্রত। ছেলেকে উত্তর দেওয়ার পালা তো পরে। আগে মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দরকার ছিল। যে কোনো শিশুই ছোটবেলা থেকে তার মা এবং বাবা, দুজনের বুকের গড়নই দেখছে। তার পরেও তার মনে যদি ওই প্রশ্ন না আসে, সেটাই তো অস্বাভাবিক। প্রশ্নটাই বরং প্রাসঙ্গিক। কিন্তু পাঁচ বছরের শিশুর ওই কৌতুহল মেটাবো কি করে ? এমন নয় যে, কোনো সহজপাঠ আছে। গ্যল্যাক্টোপয়সিস বোঝার মতো বোঝার বয়সও ওর হয় নি। বলাই যেত, ঈশ্বর ওই ভাবেই তৈরি করে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাতে না বাড়ত ঈশ্বর প্রেম, না বাড়ত বিজ্ঞান প্রীতি। বললাম, বাচ্চারা কার দুধ খেয়ে বড় হয়! বাবার না মায়ের? ও বললো, মায়েদের। এ কথার উত্তর ওকে শেখাতে হয়নি। আমি বললাম, তাহলে মায়েদের দুধ যদি নাই থাকে তবে বাচ্চারা খাবে কি করে ? তাই মায়েদের দুদুর মধ্যে দুধ থাকে। বাবাদের যেহেতু দুধ খাওয়াতে হয়না তাই তাদের দুদুগুলো ছোট।

গত কয়েকদিন ধরেই দেখছিলাম যৌন শিক্ষা নিয়ে সরব হয়েছেন নেটিজেনরা। তারা বলছেন, জাতীয় শিক্ষা নীতি তো হল, এবার চালু করা হোক যৌন শিক্ষা।সোশ্যাল মিডিয়ার ফের চর্চায় এলেও দাবিটা কিন্তু পুরানো।এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও স্কুল স্তরে যৌন শিক্ষার প্রচলন নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়েছিলো বছর কুড়ি আগেই। তখন সরকার অবশ্য এটাকে যৌন শিক্ষা না বলে জীবন শৈলী শিক্ষা বলারই পক্ষপাতী ছিলো। সরকারের বক্তব্য ছিলো, এর মাধ্যমে আসল উদ্দেশ্যটা প্রতিফলিত হয়। যদিও সোজা কথাটা সোজা ভাবে বোঝার ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট হতো কিনা তা নিয়েও সন্দেহ থাকেই।

‘খোকা শুধায় মাকে ডেকে, এলেম আমি কোথা থেকে’, এই প্রশ্ন কিন্তু শুধু আজকের নয়, সব কালের খোকা, খুকুদেরই। কিন্তু কোন বয়সে তার উত্তর কিভাবে এবং কতটুকু দিতে হবে, সেটাই মুন্সিয়ানা। জীবন বিজ্ঞান ক্লাসের অঙ্গজ, অযৌন এমনকি ব্যাঙের জননতন্ত্র পড়ে সে প্রশ্নগুলির প্রায় কোনোটিরই উত্তর মেলে না। অথচ ছেলেই হোক বা মেয়ে, উঠতি বয়সে থাকে শরীর এবং মন নিয়ে বাড়তি কিছু কৌতূহল। সেটাই স্বাভাবিক।সে প্রশ্নের উত্তর মিলবে কোত্থেকে ?
কৌতূহলী মন কিন্তু উত্তরের সন্ধান করেই চলে। খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে ফুটপাথ থেকে কিনে নেওয়া হলুদ মলাটের (আসলে সেলোফেন পেপারে মোড়া) বই কিংবা ডেবোনিয়ার কিংবা প্লে-বয় ম্যাগাজিনই তখন যেন ছিল মানে বই। তাতে প্রশ্নের উত্তর মিলতো না মোটের ওপর কিন্তু কম বয়সে অনাস্বাদিত যৌনতার খানিক স্বাদ মিলতো। যদিও তার বেশিরভাগই যৌন কেচ্ছা আর রগরগে যৌনতার গপ্পো।
আজ এটা নিয়ে বরং অনেকটা খোলামেলা কথা বলার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বছর তিরিশেক আগেও ”সত্যম শিবম সুন্দরম’ কিংবা ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ কে ঠাকুর-দেবতার বই বলে বাড়িতে কাঁচা ঢপ মেরে দিব্ব দেখে এসেছে বহু যুবকই। তাই শুনে বাড়িতে হয়তো মা কপালে হাত টা ঠেকিয়ে একবার পেন্নামও সেরে নিত। চার-পাঁচ দশক আগেই এই সুড়সুড়ির বাজারটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা পরিচালক রাজ কাপুরের। সে কারণেই ববি তে ডিম্পল কাপাদিয়াকে বিকিনি আর ‘হাম তুম এক কামরে মে’ তে মিনি স্কার্টে ব্যবহার করে ববি সুপারহিট।ডিম্পলের সেই আবেদনই ‘সাগর’-এ ব্যবহার করেছেন রমেশ সিপ্পিও।

সে সব ছিল পহেলে তুম, পহেলে তুম-র কাল। এখন সময়টা অন্যরকম। তখন উৎসব সিনেমায় শেখর সুমন এবং রেখার একখানা সাবান মাখা আর স্নানের দৃশ্য দেখে অনেকেই ভাবতেন, আহা!কেন আস্ত সাবানটাই গলিয়ে দিলো না ! আর এখন? অনায়াসেই ক্লাসে শিক্ষক বলতে পারেন, answers should be short and to the point like a girl’s miniskirt as it is decent but covers all the essentials. এখন ঘরে ঘরে কম্পিউটার, ল্যাপটপ। হাতে হাতে মোবাইল। হাজারো সাইট, আপ, গেমস, পর্ন সাইট। পাশাপাশি বসেও কানে ফোন গুঁজে কে যে কি দেখছে, শুনছে কে জানে! মোবাইলে, কম্পিউটারে রয়েছে পাসওয়ার্ড। এমনকি স্কুল পড়ুয়ারা নাকি ‘রেপ গেম’ ও খেলছে।

চ্যালেঞ্জটা তাই এখন আরও বেশি কঠিন। নেটিজেনরা বলছেন, ১৩০ কোটি জন সংখ্যার দেশে যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে অন্তত জন সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হতো। কথাটা ভুল নয়। অন্তত বিজ্ঞানের অআকখ শেখার ফলে নিশ্চিতভাবেই আরও বেশ খানিকটা সচেতনতা যে বাড়তো তাতে সন্দেহ কোথায়? সঙ্গে বাড়তো বিপরীত লিঙ্গের প্রতিও সম্ভ্রমও। অবসান ঘটতো, বেশ কিছু ভুল ধারণার, আজও যা বহন করে চলেছে সমাজ। স্ত্রী লিঙ্গের গুরুত্ব বোঝানোর ক্ষেত্রে গোটা সমাজেরই ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কোনো সন্তান পুরুষ হবে না স্ত্রী, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা কিন্তু পুরুষেরই। অন্তত মনের মধ্যে এই বিজ্ঞান ভিত্তিক ভাবনাটা ছোটোবেলা থেকেই যদি গেড়ে দেওয়া যায়, তবে এর দায় অন্তত মেয়েদের বইতে হয় না।

তাও অনেক বছর আগেকার কথা। মুক্তি পেয়েছে, ফুলন দেবীর জীবন অবলম্বনে শেখর কাপুরের পরিচালিত ছবি ‘বান্ডিট কুইন’। সিনেমায় একটা দৃশ্য ছিলো, ফুলনকে গ্রামের উচ্চবর্ণের পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঘোরাচ্ছে। সেই দৃশ্যেই শুনলাম, হুই হুই সিটির আওয়াজ। লজ্জায় কান লাল হয়ে গেলো। এই সমযে তো হল নিস্তব্ধ থাকার কথা ছিল। অন্তত কলকাতার নবীনা -র মতো একটা হল। বুঝলাম, শিক্ষাটা শুরুই হয়নি এখনো। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু স্যানিটারি প্যাডের ভেন্ডিং মেশিন বসিয়েই কেবল এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। সেটা আরও বেশি প্রকট হয় যখন কোনো মহিলা ধর্ষিতা হলে অবলীলাক্রমেই বলতে শোনা যায়, ওই ‘মেয়েছেলেটার’ চরিত্রই আসলে ছিল খারাপ।
বাহ! কি যুক্তি।

শিক্ষাটা এবার অন্তত শুরু হোক।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version