ধুন্ডীরাজ গোবিন্দ ফালকে যিনি দাদা সাহেব ফালকে নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে গণ্য করা হলেও তিনি যে আমাদের সিনেমা দুনিয়ায় খুব একটা ফোকাস পেয়েছেন একথা বলা যাবে না। আবার ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তাঁর অবদান অস্বীকারও করা যায় না। কারণ বিতর্ক থাকলেও ১৯১৩ সালে তোলা ৪০মিনিট দৈর্ঘ্যর ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ আমাদের দেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা। এই ছবিটির রচয়িতা, প্রযোজক এবং পরিচালক হলেন ধুন্ডীরাজ গোবিন্দ ফালকে।

ঢুণ্ডিরাজ গোবিন্দ দাদাসাহেব ফালকের জন্ম ১৮৭০ সালে মহারাষ্ট্রের ট্রিমবা। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল শিল্পকলার প্রতি। ১৫ বছর বয়সে ফালকে জে. জে. স্কুল অফ আর্টস থেকে পাশ করেন। পরে বরদা ইউনিভার্সিটিতে ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ফটোগ্রাফি, ইঞ্জিনিয়ারিং শেখেন। ছোটো শহরে ফটোগ্রাফির কাজ দিয়ে কর্ম জীবন শুরু করলেও ফালকের জীবনের লক্ষ্য ছিল অনেক বড়। যে কারণে তিনি  ফটোগ্রাফির কাজ ছেড়ে জার্মানি চলে যান এবং জার্মান ম্যাজিশিয়ান কার্ল হার্জের কাছে নানা ধরণের কাজ শিখে দেশে ফেরেন।

সিনেমা দুনিয়ায় পুরোপুরি পা রাখার আগে ফালকেঢ় ফোটগ্রাফার হিসেবে কাজ করার যেমন অভিঙ্গতা ছিল, একই সঙ্গে ছাপার কাজেও তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। মহারাষ্ট্রের থাঁর-এ তাঁর নিজের একটি ছাপাখানা ছিল।তিনি বেশ কিছুদিন রাজা রবি বর্মার চিত্রকর্মের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।কিন্তু তাঁকে সিনেমা বানাতে হবে। তাই এসব কাজে আর বেশিদিন নিজেকে তিনি ব্যস্ত রেখে সময় নষ্ট করতে চাইলেন না। উঠে পড়ে লাগলেন। বম্বের দাদর মেইন রোডে তাঁর স্টুডিওতে সিনেমার শ্যুটিঙের জন্য সেট নির্মাণ করলেন। কিন্তু পর্দায় কি দেখবেন? মনে মনে ঠিক করলেন হিন্দু দেবদেবীদের দেখাতে হবে। মানুষ তাদের কথা দেখতে শুনতে চায়। তাদের পছন্দের বিষয় নিয়েই শুরু করতে হবে।

ফালকে ভেবে দেখলেন, মারাঠী নাটকের মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় হল সত্যবাদী রাজা হরিশ্চন্দ্রর কাহিনি। এরপরেই ঠিক করলেন সেই সত্যবাদী ও রাজা হরিশ্চন্দ্রর  কাহিনি নিয়েই তিনি ছবি করবেন। ধার্মিক রাজা হরিশচন্দ্র কিভাবে বিশ্বামিত্রকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য একে একে তাঁর রাজ্য, স্ত্রী ও সন্তানদের বলিপ্রদান করেন, সেই কাহিনীকে কেন্দ্র করে ফালকে তার ছবির কাহিনি ও চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন।

ফালকে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও তিনি তাঁর সিনেমার মধ্যে জড়িয়ে নিলেন। তাঁরা সবাই মিলে দিনরাত পরিশ্রম শুরু করে দিল। কিন্তু সমস্যা হল; নারী চরিত্রে কোনও মহিলা অভিনয় করতে রাজি হলেন না। অগত্যা দত্তাত্রেয় দামোদর দাবকে নামে একজন মারাঠি মঞ্চ অভিনেতাকে দিয়ে ফালকে হরিশচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করান। আন্না সলুঙ্কে নামে আরও একজন পুরুষ অভিনেতা অভিনয় করেন হরিশচন্দ্রের পত্নী তারামতীর ভূমিকায়। দাদাসাহেব ফালকের পুত্র বালচন্দ্র ফালকে হরিশচন্দ্রের পুত্র রোহতাশের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

ফালকের তৈরি ভারতীয় ৪০ মিনিট সময়ের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ করতে সাত মাস একুশ দিন সময় লাগে। ১৯১৩ সালের ২১শে এপ্রিল বম্বে শহরের গ্র্যান্ট রোডের অলিম্পিয়া থিয়েটারে সেই শহরের বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে প্রথম ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ দেখানো হয়। এরপর ১৯১৩ সালের ৩ মে বোম্বের করোনেশন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’।

দাদাসাহেব ফালকে একসময় চিত্রকর রাজা রবি বর্মার সঙ্গে কাজ করতেন।চিত্রকলার একটা বিরাট প্রভাব ফালকের উপর ছিলই, বিশেষ করে রাজা রবি বর্মার কাজ। যে কারণে তাঁর ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ছবিতে হিন্দু পৌরাণিক ঘটনাগুলির ওপর রবি বর্মার বেশ কয়েকটি ছবি দাদাসাহেব তার চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন।

ফালকে সিনেমা দুনিয়ায় জড়িয়ে ছিলেন ১৯ বছর। তার মধ্যে তিনি ৯৫টি ছবি তৈরি করেছিলেন। সেই ছবিগুলি হল—‘মোহিনী ভাসমাসুর’, ‘সত্যবান সাবিত্রী’, ‘লঙ্কা দহন’, ‘শ্রীকৃষ্ণ জন্ম’, ‘কালিয়া মর্দন’ ইত্যাদি। বোঝাই যায় পৌরাণিক কাহিনিকেই তিনি তার সিনেমার বিষয় বেছেছিলেন। এছাড়া আরও ২৬টি স্বল্প দৈর্ঘের ছবি বানান ফালকে। তবে শব্দ এসে পড়ার পর ফালকে সিনেমা নিয়ে আর তেমন কিছু এগতে পারেন না।

ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ নির্মাণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০০৯ সালে হরিশচন্দ্রাচী ফ্যাক্টরী নামক একটি মারাঠি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ মুক্তির পর ব্যাপক বাণিজ্যসফলতার মুখ দেখেছিল। যে কারণে পরে আরও কয়েকটি প্রিন্ট করে তা অন্যত্র পাঠানো হয়। ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ ছবিটির চারটি রিল কিন্তু বর্তমানে পুণের রাষ্ট্রীয় ফিল্ম সংগ্রহালয়ে প্রথম ও শেষ রিলটি অবশিষ্ট রয়েছে। ভারতীয় সিনেমার জনকের সম্মানে ১৯৬৯ সাল থেকে ভারত সরকার তাঁর স্মৃতিতে ভারতীয় সিনেমায় অবদানের জন্য ‘দাদসাহেব ফালকে’ পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version