বানভাসি চৈতি সন্ধ্যায় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। সঙ্গে অজস্র ধুলোবালি, ঝাঁক ঝাঁক গুঁড়ো কুয়াশা। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের মায়া ঘেরা একরাশ মন কেমনের তরঙ্গ। যেন সময়ের পলিতে থেঁতলে যাওয়া ঝাঁক ঝাঁক সোনালী মুহূর্তের পুনরুজ্জীবন। কালান্তরি গুহার গ্রাসে আটকে থাকা কলকল জলধারার আচমকা মুক্তির প্লাবন। যেন রঙিন জলভরা এক ঝাঁক বেলুন কেউ ছুঁড়ে দিল তামাটে এই বক্ষ মাঝে।

আমাদের চঞ্চল শৈশব, আমাদের দামাল কৈশোর, আমাদের উদ্দাম যৌবন, আমাদের দুর্মর ভালোবাসা, এবং মন্দবাসা… সব ফেলে এসেছি সেই কতকাল! সব যেন দুরন্ত ঢেউয়ের উল্লাসে হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল। বসন্ত বাতাসের গায়ে যেন অতি পরিচিত সেই গন্ধ। মায়াবী চৈত্রের সোহাগী করতলে যেন সেই চেনা উত্তাপ। রঙিন দিগন্তের চাহনিতে যেন অবিকল সেই আবেদন। বহুকাল পরে সব যেন উড়ে এলো এক লহমায়! কোন্‌ অবেলার মেঘের মতো, বানভাসি ইচ্ছেগুলো যেন আকাশ ছুঁল!

আমাদের শৈশব বা কৈশোরে আজকালের মতো এত বড় পৃথিবী ছিল না। দেশের সীমানা পেরিয়ে মার্ক্স, লেনিন, মাও দে জং, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা, চেকভ, পুস্কিন, গোর্কি ছাড়িয়ে বড়জোর গ্যেটে, মঁপাসা কিংবা পাবলো পিকাসো বা শার্লক হোমস্‌ পর্যন্ত। বন্ধু, বিশেষ বন্ধু, অন্তরঙ্গ বন্ধু, পালকে পালক লাগা বন্ধু… সকলের গায়েই ভুরভুর করতো পাড়া, ইস্কুল অথবা অঞ্চলেরই সুবাস। বস্তুত, আমাদের কালে হাতে গোনা কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া, আন্তর্জাতিকতা দূরে থাক, পাড়া, ইস্কুল বা অঞ্চলের পরিধির নাগালের বাইরে কোন কিছুই থাকতো না।

ভোরের সমুজ্জ্বল রোদ্দুরের আঙুল তখনও, সিঙ্গাপুর, পাটায়া, ব্যাংকক তো বহুদুর, হ্যাভলক্‌ সমুদ্র সৈকতের চিকচিকে বালুকণাও স্পর্শ করেনি। তিলতিল করে গড়ে তোলা কল্পনার নীল পাহাড় এসে বড়জোর মিলে যেতো বাতাসিয়া লুপের কনকনে বাতাসে। সেই সব দিনে, টেমস্‌ বা ভল্গার উদ্বেলিত ঢেউ এসে অনায়াসে প্লাবিত করে দিত ইছামতীর টলটলে হৃদয়। কত ছোট পৃথিবীতে বাস, অথচ কত সহস্র কল্পলোকের প্রতিনিয়ত যাতায়াত! কত রংবেরঙের প্রজাপতি এসে উবু হয়ে বসতো অতলান্তিক উচ্ছ্বাস ভরা জীবনের শাখাপ্রশাখায়!

নিদাঘ দুপুরগুলো হঠাৎ যেন ঘুরে ফিরে আসে মায়া ঘেরা পুকুরের টলটলে মেঘ-বারান্দার অমোঘ আকর্ষণে। পুকুরের অন্তঃপুরে পাক খেতে থাকে অন্তহীন মুক্তির দমকা বাতাস। পদ্ম পাতার কোলে টলমল করে ওঠে স্মৃতি ভরা অসংখ্য জলবিন্দু। পুকুরের টানে হেলে পড়া নারকেল গাছের পাতার আঙুলের ইশারায় দুলতে থাকে অজস্র বিস্মৃত জলফড়িং। মেঠো ফুল খিলখিল করে হেসে ওঠে। ঘাসে ঘাসে দোল খায় পরিত্যক্ত সোহাগের উচ্ছিষ্ট আবেশ।

তখন কতই বা বয়স হবে! তখন পৃথিবী রঙে রঙে রাঙা। উদ্ধত শরীর বেয়ে তখন হুড়মুড়িয়ে নেমে আসা বসন্ত। উচাটন মন জুড়ে রঙিন ফানুশ অসংখ্য। উদ্বেলিত শিমূলের ঠোঁটে আকাঙ্ক্ষা অনন্ত! তারপর, রঙিন দিনের অন্তে আলোআঁধারি দিগন্তের কপালে ঝলমল করে উঠত দোল পূর্ণিমার চাঁদ। উতলা বাতাসের হৃদয়ের খাঁজে অব্যক্ত ব্যাকুলতার অস্থির নিঃশ্বাস। স্পষ্ট শুনতে পাই, কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি প্রলাপ। অগোছালো খোপা বেয়ে নেমে আসে জুঁইয়ের আকুতি। জ্যোৎস্নায় ধোয়া দিগন্ত ভেসে যায় আঙুলে আঙুল ছোঁওয়ার উদ্দাম উচ্ছ্বাসে।  

কোন এক থইথই দোল পূর্ণিমার রাতগভীরে, মুঠোয় জোনাকি ভরে এসেছিল সে। কত কথা যে তাঁকে বলার ছিল। জন্মান্তরের আড়ালে ঢেকে রাখা সব কথাগুলো তারও উন্মুক্ত করার কথা ছিল। জ্যোৎস্না ধোয়া বানভাসি ভালোবাসার প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল সব… কাঁপা কাঁপা আঙুলের আকুতি, হৃদয়ের রক্তস্রোতের দুর্বার অনুরণন, চোখের পাতা বেয়ে নেমে আসা দুর্মর উচ্ছ্বাস, না-বলা কথার স্রোতে ভেসে যাওয়া সকরুণ আর্তনাদ।

সেই কবে এক বসন্ত দিনে আঙুলে আঙুল ছুঁয়েছিল অকপট প্রেম। সেই কবে এক শিমূল রঙা দিনদুপুরে, গাল বেয়ে গলে পড়া আবেগের প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল অবুঝ হৃদয়। প্লাবিত সেই হৃদয় তবু ফিসফিসিয়ে বলেছিল, “তুই যদি চাস ফাগুন আবার, আনতে পারি রক্ত পলাশ”।

তার পর… রঙিন দিগন্ত পার হয়ে কত উতলা ফাগুন লোনা সাগরে মিশে একাকার হয়ে গেল! কত জনমের উচ্ছ্বাস বয়ে দখিণা বাতাসের চোখে জন্মান্তরের ক্লান্তি ভরে এল। ঝরা পাতার নিস্তরঙ্গ বক্ষ মাঝে কত যে নেশাতুর মহুল রাতভর টুপটাপ ঝরে পড়লো। তবু রক্তপলাশ আর খুঁজে আনা হল না।

লেখক অধ্যাপক, সমাজ, রাজনীতি ও পরিবেশ বিশ্লেষক

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version