(গত সংখ্যার পর)

মনি দাদুর মুখে প্রশংসা শুনে লখাই একটু বেশিই খুশি হলো। এই রকম ভাবে তাকে আর কেউ সমাদর করে নি। প্রখর বাস্তবতায় মোড়া এই মনি বাবু অকারণে কাউকেই “একস্ট্রা মাইলেজ” দেননি কোনো দিনই। পারিবারিক পরম্পরা, ঐতিহ্য আর সাবেকীয়ানাকে যেমন মর্যাদা দেন তেমনই প্রাচ্য পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতিকেও গুরুত্ব দেন সমান ভাবে। বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করার দরুন পরিবারের প্রাচীনপন্থীদের মনে একটু খটকা লেগেছিল বৈকি। কিছুদিন পর সবাই তা মেনেও নিয়েছিলেন। আজকের অপরাহ্ন বেলায় সেই সব ভাবনাচিন্তা ভিড় করে মনিবাবুর অন্তরে। চাটুজ্যে বাড়ির দেউড়িতে জমে আছে কত শত পরিবর্তন আর প্রগতির ইতিহাস।

রুদ্র আর সূর্য নিজদের মধ্যে বলাবলি করছে, লখাইয়ের আমেরিকা যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে। মনিবাবু জাত জহুরী সেই কথা বিলক্ষণ জানে এই দুই ভাই। বিলক্ষণ এও জানে যে বাঙলার গৌরবময় ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে বিশ্ব মাঝারে তুলে ধরাই মনিবাবুর প্রধান লক্ষ্য।

লখাই মঞ্চ থেকে নেমে পাশেই অতিথিদের জন্য বসার জায়গায় চলে এলো। মনিবাবুর বক্তব্য শেষ হতেই রুদ্র মাইকে ঘোষণা করল পরবর্তী শিল্পীর নাম। এখন বাউল গান শোনাবেন সোনামুখী বোলবোম আখড়ার সাধন দাস বাউল। প্রথমেই গুরুবন্দনা সেরে বিখ্যাত পদকর্তা ও সাধক সনাতন দাস বাউলের গান ধরলো। সাধনের উদাত্ত গলায় দেহতত্ত্ব ও সাধন ভজনের গান জমে উঠলো গোটা আসর জুড়ে। পরের পর গান গেয়ে নেচে শ্রোতা দর্শকদের মন আজ কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে।  তার বাবা ও বৈষ্ণব সাধু গুরুর উপদেশ মেনেই বাউলাঙ্গকে আঁকড়ে রেখেছে সেদিনের ছোট্ট সাধন। এই জমিদার বাড়ি ছিল তার মা বাবার বাঁধা আসর। কয়েকদিন ধরে গানের টানে জমিদার বাড়িতে ডেরা বাঁধতে হত তাদের। ছোটবেলা থেকেই বাবা মায়ের হাত ধরে সাধন আসতো জুড়িদার হিসেবে। তার হাতে থাকতো প্রেমজুরি আর খঞ্জনী। ফাঁকা থাকলে কিম্বা মেলা মোচ্ছবে এদিকে এলে গুরু গোঁসাই ও সিদ্ধ বাউল সনাতন দাসের আশ্রমে চলে আসত তারা।

আজ সাধনের মাথায় বাঁধা মোহন চূড়া, দু’পায়ে ঘুঙুর। পোশাকও ছিল ট্র্যাডিশনাল সাধু বাউলের মতো। তার মা তাকে সাজিয়ে দিতেন সন্ধ্যা হলেই। মায়ের কাছেই তার শৈশব থেকে চর্চা শুরু হয়। আর একটু বড়বেলায় রীতিমতো গুরুশিষ্য পরম্পরায় গাইতে উঠতো আসরে। বাঙলার সমস্ত মেলা মোচ্ছবে কত বৈষ্ণব বৈষ্ণবী, সাধু বাউলের সঙ্গে চেনা জানা হয়ে গেছে তার। দু’তিনবার বিদেশেও গেছে গানের ভেলা নিয়ে। তার মধ্যে এই মনিবাবুর দৌলতেই একমাসের জন্য আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় আসর করেছে বাবা মায়ের সঙ্গে। তখন বয়সে তরুণ আজকের নামকরা সাধন দাস বাউল বিদেশের মাটিতে খুব নাম কুড়িয়েছিল। আর একবার বিলেতের মাটিতে দীর্ঘ দু’মাস প্রবাসী বাঙ্গালিদের উৎসবে যোগ দিয়েছিল তার বাবা মায়ের বাউল ট্রুপ।

মনিবাবু একাত্ম হয়ে শুনছেন সাধনের গাওয়া বিভিন্ন ধারার বাউল গানগুলো। আসরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা শ্রোতা দর্শক মন্ডলীও শুনছে বিভোর হয়ে।

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version