(গত সংখ্যার পর)

কলকাতার বড়বাবু চুরুট খেতেন হরদম। তার কাছে জমে থাকা কয়েকটি চুরুট আর পাইপ নিয়ে এসেছে বন্ধুদের খাওয়াবে বলে। কাল সকাল সকাল দু’তিনজন বন্ধু মিলে যাবে শুশুনিয়ার ধারা’র মেলায়। গোরা শুনেছে মেলা উপলক্ষ্যে নদীয়ার বিখ্যাত পুতুল নাচ আর বালিকা সঙ্গীতের দল এসেছে। এও জানতে পেরেছে শিলাইজোড়, ধ্বতলা ও হেঁসলা গাঁয়ের ছেলে মেয়েদের নিয়ে গড়ে উঠেছে বালিকা সঙ্গীতের দল। এই কথা শুনে গোরার কৌতুহল বেড়ে গেল বহুগুণ। মনস্থির করে ফেললো সে। যদি তাকে দলে নেয় তাহলে সে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যাবে।

সেই রকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রসরাজের সঙ্গে দেখা করে নিল। তখন জোরকদমে রিহার্সাল চলছে দলের। এরই মাঝে গোরার দক্ষতার বিষয়ে খোঁজ নিল রসরাজ। নবাগত সুশ্রী যুবক গোরাকে অবাক চোখে দেখছে কাল্লা, শিবানী সহ দলের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা। প্রথমে গোরাকে গান দিয়ে শুরু করতে হল। গানের পর সংলাপ দিয়ে দক্ষতার পরীক্ষা হল। একটুও আড়ষ্ট না হয়ে খোল করতাল সহযোগে গোরা সুর তোলে তার নিজস্ব গায়ন রীতিতে। ভরাট গলায় গেয়ে উঠলো- “বনমালী গো… ও…. ও / পর জনমে হইয়ো রাধা …! পর পর তিনখানি গানের অন্তরা বা মুখড়া গেয়ে গোরা সকলের প্রশংসা ও ভালোবাসা কুড়িয়ে নিল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল শ্রীমতী রাধারানী হবে কাল্লা। আর তার বিপরীতে থাকবে কানাই / কান্হু চরিত্রে গোরা। পরীক্ষামূলক ভাবে বাসলী তলার মঞ্চে প্রথম রজনীর শো হয়ে গেল সুপার ডুপার। কি‌ অসাধারণ কম্বিনেশনে নাচ গান আর সংলাপে মাতিয়ে দিল গোটা দল। দলে গোরা প্রথম রজনীর অভিনয়ে প্রশংসা কুড়িয়ে নিল। অভিনয় শেষে রসরাজকে প্রনাম করলো গোরা। রসরাজ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। স্বগতোক্তির সঙ্গে বলে উঠলো, তুই ছাই চাপা আগুন রে বাবা! অনেক দূর যাবি তুই। গোরার সর্বাঙ্গে খেলে যায় এক মহাতরঙ্গ। তখনও অভিনয়ের পোশাক খোলা হয়নি। মুখ হাত থেকে তোলা হয়নি পেইন্ট। ফ্যাল ফ্যাল করে গোরার দিকে তাকিয়ে দেখে কাল্লাবতী। এখনও রাই কিশোরীর ঘোর কাটেনি। গোরার মনও ভরে গেছে তৃপ্তির রসে। আজ প্রথম দলগত অভিনয়ে কানাই ও রাই কিশোরীর অভিনয়ের ঘনিষ্ঠ মূহুর্তগুলো বিমূর্ত হয়ে উঠেছিল। রাইকে জড়িয়ে বাঁশি হাতে কানাইয়ের গান গাওয়ার মূহুর্তটি ছিল এক অমোঘ দৃশ্য। কাল্লার মনেও শিহরণ জেগে ওঠে। দর্শকদের মন জয় করে নেয় আজকের সাবলীল ও যুগল অভিনয়। রসরাজের তাড়ায় সবাই সাজগোজ খুলে সাধারণ পোশাকে তৈরি হয়ে যায়। এবার রাতের খাবারের জন্য তাগাদা দেয় মেলা কমিটির লোকজন।

আবার কালকের নতুন পালার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে গোটা দলকে। প্রতিদিন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে গোরাকে। বিশেষ ভাবে কাল্লা’র সঙ্গে সকাল থেকেই সংলাপ আর গানের তালিম নিতে হবে। বাজনদার থেকে প্রম্পটারের সঙ্গে ঝালিয়ে নিতে হবে মনযোগ দিয়ে। সঙ্গে থাকবে রসরাজের বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও টিপস্।

সেই দিনের স্মৃতি আর স্মরণীয় কথাগুলো মনে পড়লে হা হুতাশ করে কাল্লা। অভিনয়ের মাঝেও সে গোরার প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করে। মনে মনে ভাবে তার প্রথম যৈবন কালের কথা। প্রথম যখন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরতে শিখলো ঠিক তখুনি কেউ যেন কানে কানে বলে গেল ভালো লাগা, ভালোবাসার কথা। সেই মানুষটি কি কানাইয়ের আড়ালে গোরা? আর ঠিক তখনই বয়ে যায় বসন্তের বাতাস।  কাল্লা ভয় পেয়েছিল সেই বসন্তের বাতাসকে। তারপর সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল বসন্ত বিলাপের মধ্যে। নিজেকে আবদ্ধ করলো মায়ের সঙ্গে ঘর সংসারের কাজে। এখন কাল্লা অনেক পরিনত। তার প্রিয় গায়ক গোঁসাইজীর সঙ্গে যে ঢঙে কথা বলে সেটাতেও মিশে থাকে অন্তরের ভক্তি শ্রদ্ধা। তার গান কাল্লার হিয়াকে আকূল করে তোলে। কাল্লা যতটা চটুল আবার গোঁসাইজী ঠিক ততটাই নির্বিকার, উদাসী।

গোঁসাইজীকে লক্ষ্য করে আবার শুরু হয় তার রসে মাখা ভাঁজ। কাল্লা নরম গলায় বলে ওঠে- আগুন আছে তুমার কাছে গুঁসাইজী? সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ফিরিয়ে নেয় কাল্লা। রসিকতার সুরে বলে উঠল- তুমি ত লিজেই একট্যা আগুনের ঢ্যালা গো, তুমি ইদিকটায় আল্যেই কত কি পুঢ়্যে খাক্ হঁয়্যে যায়। বড়ু কবির পদাবলী থ্যাকে তুমিই একদিন বল্যেছিলে ন-‘ কাহ্নর বিরহে বন পুড়্যে, মন পুড়্যে যাঁওয়ার মতন অবস্থা শ্রীমতীর। কুমহার ঘরের পুহানের মতন শ্রীমতীর মনের অবস্থা। আরহ কত কি বল্যেছিল্যে হে মহাজন! আহা! পরাণট্যা জুড়হাই যায় হে! দু’ডগ পদাবলী আইজ শুনহাও হে গুঁসাইজী। কাল্লার সরল নিষ্পাপ মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রসিক গোঁসাই। গভীর দুখানি চোখ, টলটলে জল ভরা দিঘীর মতোই। প্রশস্ত কপাল, কানের দু’পাশ বেয়ে নেমে আসছে দীঘল কালো চুলের রাশি। বাঁশির মতো চিকন কালো নাক। তার রূপ মাধুর্যে ডুব দিয়ে কি যেন খুঁজে ফেরে গোঁসাইজী। 

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version