(গত রবিবারের পর)

শোভন শুধু ফিসফিস করে বলে উঠলো “ভিখারিদের সাম্যবাদ” কথাটি। আমি কঁকিয়ে উঠলাম তার মুখে ফোটা নতুন শব্দবন্ধটি শুনে। আগে তো শোনা কোন্ ছার,  কোনও কালে মনে উঁকিও দেয়নি এই শাশ্বত শব্দবন্ধটি। আমাদের কাজকর্ম নিয়ে দলটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা আর গুঞ্জন শুরু করে দিল। আমি ভনিতা করে বললাম, তোমাদের কোনও অসুবিধা বা সমস্যা হবে না। শুধু তোমাদের এই লড়াই, বাঁচার শপথের কথা আমরা তুলে রাখতে চাই। একজন মাঝবয়সী সুঠাম দেহের অধিকারিণী মহিলা বলে উঠলো- শুনহ বাবু, আমরা তো সমাজের ঠিনে অচ্ছ্যুৎ। ভিক্ কইরে খাই। আমদের ঘরদুয়ার নাই। গটা পিথিমীট্যাই আমদের ঘর। তাই আমদের দুখ্ কে বুইঝব্যেক্? বিদ্যুতের ঝলকানির মতো তীক্ষ্ণ শানিত ক্ষোভ চলকে উঠলো তার কথায়। যেন মনে হলো পরিশীলিত সমাজ ব্যাবস্থার তলপেটে লাথি মারলো সজোরে। 

প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি? আমার নাম সাগরী, সাগরবালা দাসী। থাকো কোথায়? -ঘরবাড়ি নাই খ বাবু। হুই… পুরুল্যার ছড়রা রেলপাড়ের ঝুপড়িতে থাকি। মা,বাবা কভেই সেঁধ্যাইছ্যে। ভাই ভায়াদরা খেদড়াই দিলহি ঘরের লে। জলভরা চোখে, ভারী হয়ে ওঠা গলায় সাগরী বলে উঠলো- থাক ন বাবু আমদের ভাঙাচুরহা জীবনের কথা। কয়েন আর নোটগুলো আলাদা করতে ব্যাস্ত মাঝবয়সী মঙলু ওরফে মঙ্গল। সে বলে উঠলো সারাদিন দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ মাঙ্গ্যে হৈয়রান হঁয়্যে মইরে গেছি হে। টুকু শান্তিতে কাজট্য আমদের করত্যে দাও ন বাবু। ওদেরই একজন শীর্ণকায় রুগ্ন দেহের লোকটি চাল, কলা, মুলো, কুমড়া, বেগুন, টম্যাটো, ফলমূল ,মিষ্টি ভাগ করতে ব্যাস্ত। সারাদিন ভিক্ষা করে পাওয়া সামগ্ৰী সমানভাবে ভাগ করে নেয়। আজ ওদের বারো ভাগে ভাগ হচ্ছে সমস্ত জিনিস। এক টাকা, দু’টাকা, পাঁচ টাকার কয়েনগুলো গুণে গুণে থাক করছে। নোটগুলোও আলাদা আলাদাভাবে গুছিয়ে নিচ্ছে। আজ ওদের কপাল ভালো। দুটো একশো টাকার নোট দিয়েছে কোনও সহৃদয়বান মানুষ। শহরের দু’একটি পরিবার কয়েকটি পুরানো শীতবস্ত্র দিয়েছে তাদের। সবার শেষে সেইগুলো ভাগ হবে। ক’টা বাজল্য বাবু? ঘড়ি দেখে সময় বলতেই, আঁতকে উঠলো বয়স্কা মহিলাটি।ঢের দেরি আছে ইখ্যনো। কৌতুহল মেটাতে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন্ দিকের ট্রেন ধরবে মাসী? বিষ্টুপুর যাব হে!  ওদেরই একজন বছর তিরিশের যুবতী বিকৃত হাসি হেসে বলে উঠলো, লে! ইবার ঠেলা সামলা। এ সাবি দিদি তুই ত ই বাবুটার মাসী হঁয়্যে গেলি গো! সাবি একটু উষ্মা ঝরা গলায় বলে উঠল, বলি তর কি জ্বলন ধইরল্য? যুবতীটি এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে ছিল ‘রোদন ভরা বসন্ত’র ছোঁয়া। গভীর ব্যাপ্তি ও ব্যাঞ্জনা ছিল তার মুখমন্ডল জুড়ে। হাসি থামিয়ে আবার বলে উঠলো, হ্যাঁ সাবি দিদি, তর ত আঁঢ়্যা গরুও নাই, বিচ ধানও নাই খ! আর সেঁহাল্যেই টাটকা মাসী ট্য হঁয়্যে গেলহি ত! তর সনার বন্ন ই বুইনপ্য টি কুথাকার? তুই চুপ দিভি মাগী? সাবি এবার মেজাজ হারিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো। সাবির পুরো নাম হল সাবিত্রী। আর যুবতীটির নাম পদ্মাবতী। ওদের কাছে শুধুই- পদী। অনেকক্ষণ ধরে আমাদেরও ঘঁসে মেজে নিল তাদের প্রখর পর্যবেক্ষণ শক্তির কষ্টি পাথরে।

দলের সর্বময় কর্তা মঙ্গল ওরফে মঙলু একে একে সবারই ভাগের জিনিস বুঝিয়ে দিল। নিজের নিজের ভাগ বুঝে নিয়ে এবার শীত পোশাক গুলোর আপোষ বন্টনে মনোনিবেশ করলো। দুটো খয়াটে শাল চাদর, চারটে নানা সাইজের সোয়েটার আর বেশ ভালো কোয়ালিটির দুটো কার্ডিগান পেয়েছে। ইতিমধ্যে পদী নিজের পছন্দমতো হলুদ কালো ছোপ ছোপ কার্ডিগানটি টানা হ্যাঁচড়া করে চলেছে। শেষে সবারই একমত পদীই পাবে ওই সুন্দর শীত পোশাকটি। মঙলু রসিকতা করে বলে উঠলো- তুই ত আমদের দলের হিরোইন- পদী সুন্দরী। সাবি যোগ করলো- উ ত আমদের দলের লুটন পায়রা গো! রেলগাড়িতে, ইস্টিশনে, বড় বাস স্ট্যান্ডে কত লোক ফ্যাল ফ্যাল কইরে দেইখত্যে থাকে উয়াকে! যেমন চাট্যে চাট্যে খায়। এই সাবি, আবাগী! তুই চুপ করবি! মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে পদী। দেখ মঙলু দাদু ইবারে কুছু বলল্যে সাবি মাগীর চুইল জঁটটা ছিঁড়্যে দুব অ! পরিস্থিতি হালকা করতে মঙলু বলে উঠলো, ইবারে থাম সবাই। হেই বাবুরা! ই সব কথার আর হ ফটোক তুল্যে দিও না হে!

দূর থেকে ভেসে আসে রেলের হুইসেল। কিছুক্ষণ পরেই ১নং প্লাটফর্মে ঢুকবে হাতিয়া- খড়্গপুর  প্যাসেঞ্জার। তারপরেই আসবে খড়্গপুর- আসানশোল লোকাল। দুটো ট্রেনে ওরা বারোজন ভাগ হয়ে যাবে। সাবি, পদী, খাঁদু আর লখাই যাবে বিষ্টুপুর। মঙলু, সাগরী, বিশু, সহ বাকিরা যাবে আনাড়া, ছড়রা ও পুরুলিয়ায়। পদী আর মঙলুর মোবাইল ফোন আছে। তারা প্রত্যেকের খোঁজ খবর নিয়ে যে যার ডেরায় ঢোকে। আমাদের সামনে দিয়ে ফুটবল চায়ের ফ্লাস্ক আর একহাতে মাটির ভাঁড় ভরতি প্লাস্টিকের বালতি নিয়ে হনহনিয়ে যেতেই অনুপ হাঁক পাড়ে। ফিডার রোডের বাসিন্দা ফুটবল স্বগতোক্তির সঙ্গে বলে ওঠে- ডোন্ট মাইন্ড, রিপোর্টার দাদাগণ! ফুটবলকে ভুল বুঝবেন না। ধরুন ভাঁড়, ঢালুন চা। ফুটবল বরাবরই রসিক মনের মানুষ। সেই কোন্ ছোটবেলায় পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে বাবার সঙ্গেই হাত পাকিয়েছে হকারগিরির। সকালে পরপর তিনটে দূরপাল্লার ট্রেন যায় খড়্গপুর ও হাওড়ামুখী। সাতসকালেই ফুটবল হাজির রসিকতা আর ভাঁড়ে গরম চা নিয়ে। এখনকার উঠতি শীতে চায়ের কদর বাড়ছে ক্রমশ।

ওরা বারোজন কখন দু’দিকের ট্রেন ধরে চলে গেছে যে- যার গন্তব্যে। শুধু শেষ সময়ে আমাদের কাছে এলেন কীর্তনীয়া গোউর বোষ্টম। আগামী অঘ্রানে নিজের মেয়ের কন্ঠি বদল অনুষ্ঠানের জন্য আন্তরিক ভাবে নেমন্তন্ন করে গেল গোউর ওরফে গৌরহরি দাস। তিনজনকেই জোড় হাত করে বিনীত ভাবে গরীব বৈষ্ণবের কুঁড়েঘরে যাওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানালো। এও জানালো, হবু জামাইকেও নাকি আমরা চিনি। 

(পরের অধ্যায় আগামী রবিবার)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version