(গত সংখ্যার পর)

কিছুক্ষণ পরেই শশিশেখর এলেন কাছারি বাড়ির দেওয়ান মহলে। আগেই খবর দেওয়া ছিল তহশিলদার, খাজাঞ্চি ও নায়েব মশাইকে। একই সঙ্গে আগাম বলা ছিল রুদ্রশেখর ও চন্দ্রশেখরকে। এবারই ঠারে ঠারে বোঝানো হয়েছিল নতুন প্রজন্মের এই দুই ভাইকে দায়িত্ব পালনের জন্য। পারিবারিক, সামাজিক ও বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হবে আজ থেকেই। সেই লক্ষ্যেই আজকের গুরুত্বপূর্ণ এই সভা। বড় তরফের পাশাপাশি আরও দুই শরিক মেজো ও ছোট তরফকেও ডাকা হয়েছে পারিবারিক সিদ্ধান্ত সভায় অংশ নিতে। ছোট ও মেজো তরফের পক্ষে কয়েকটি প্রস্তাব ও দাবি জানানো হয়েছিল আগাম। বাৎসরিক দুর্গোৎসবে কারা কারা, কতজন আসতে পারবেন গুরুত্বপূর্ণ সেই কথাটাও জেনে নেওয়া হয় ফি-বছর। 

কলকাতা, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, আসানসোল, ধানবাদ, রাঁচি, হাজারিবাগ, কোডার্মা, জামশেদপুর সহ অন্যান্য খনি শিল্পাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চাটুজ্যে বাড়ির পরিবার পরিজন। আবার চা বাগানের মালিকানার দরুন দু’চারজন দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও অসমে বসবাস করেন। শুধু চা বাগানই নয়, রয়েছে হোটেল, রিসর্ট।  বর্তমান পরিস্থিতিতে পরবর্তী প্রজন্ম বেশ মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। দেশের খোলা বাজার অর্থনীতিতে বেশ মানানসই শিল্প বানিজ্যে ঢুকে পড়েছে। এদেরই বেশ কয়েকজন অংশীদারি ব্যবসাতেও সাফল্যের মুখ দেখেছে।

একটি পরিবারের এতোবড় সাফল্য একদিনে আসেনি। তার জন্য রীতিমতো বিষয় ও লাইন ধরে পড়াশোনা করতে হয়েছে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের। ম্যান ম্যানেজমেন্টেও এই পরিবারের তরুণ ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিদের অভাবনীয় ভাবনা চিন্তা রয়েছে। পেশাদার ও দক্ষ কর্মী হিসেবে নিজেরাই গড়ে নিয়েছেন নিজেদের ও পাশাপাশি গ্ৰামের ছেলেমেয়েদের। তাদের অধীনে কয়েকশো ছেলেমেয়ের কর্ম সংস্থান হয়েছে। সম্প্রতি দেশের সরকারের কাছে অনুমোদন পেয়েছে স্কিল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড স্টাডি সেন্টারের। মহিলা ও পুরুষদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বশিক্ষিত করে তোলা হবে। যেখানে গ্ৰামে বসেই স্বনির্ভরতার মাধ্যমে দুটো পয়সা আয় করতে পারবে। তার জন্য তাদের কোনও খরচ দিতে হবে না। প্রাথমিকভাবে এই প্রশিক্ষণ বিষয়ে কর্মশালা হয়ে গেছে। উৎপাদন, বিপনন ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা দানের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়ে গেছে।

জমিদার বাড়ির তিন তরফ ছাড়াও আসেন মেয়ে জামাই সহ এ বাড়ির ছেলেদের শ্বশুর বাড়ির লোকজন। চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায়না। এটা শুধু কথার কথা নয়। ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের মানুষজন বছরের ক’টা দিন নিজেদের গ্ৰামে আসেন শিকড়ের টানে। একে একে এসে হাজির হচ্ছেন দেওয়ান মহলে। ছোট তরফের পক্ষে হরিহর চাটুজ্যে আর মেজো তরফের পক্ষে হেমাঙ্গিনী বৌঠান আর বড় নাতি সৌম্যশেখর এসে হাজির হয়েছেন আজকের সভায়। পুরোহিত, ঢাঁকি, মালাকার, কুম্ভকার, নাপিত সহ অন্যান্য পারিবারিক কাজে নিয়োজিত এরকম কয়েকজনকেও ডাকা হয়েছে। এই সাধারন সভার পরে নিজেদের পারিবারিক কয়েকটি খুচরো খাচরা সমস্যা নিয়েও আলোচনা হবে। 

একে একে দেওয়ান হলে এসে বসতে শুরু করলেন আজকের গুরুত্বপূর্ণ সভায় আমন্ত্রিত ব্যাক্তিবর্গ। শশিশেখর একবার তীক্ষ্ণ নজরে দেখে নিলেন সভাস্থলে আগত সদস্যদের। তিনি বসে আছেন আরাম কেদারায়। এখন আর তামাক না খেলেও সাজানো আছে গড়গড়ে। রূপোর এই গড়গড়েরও অনেক ইতিহাস আছে। কেউ না খেলেও ব্যাবহারযোগ্য করে রাখতে হয় সবদিনই। শশিশেখরের দু’পাশে পাঁচজন পারিবারিক সদস্য ও হেমাঙ্গিনী বৌঠান বসে আছেন। সামনে পুরোহিত বসেছেন। মুন্সিকে সভা শুরুর ইঙ্গিত দিলে তিনি পুরোহিতকে আহ্বান জানালেন। পুরোহিত চাটুজ্যেবাড়ির প্রথামাফিক সভার শুরুতেই মঙ্গলাচরণ ও স্তোত্র পাঠ করলেন। তিনি মঙ্গল কামনা করে তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। আজকের সভায় মূখ্য ও প্রবীণ সদস্য হিসেবে শশিশেখর স্বাগত বক্তব্য পেশ করলেন। সেই বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত ও প্রাসঙ্গিক।

চলবে…

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version