(গত সংখ্যার পর)

দেশে স্বাধীনতা এলেও মানুষের মনে এমনকি জনজীবনে শান্তি এলো না। চারিদিকে হতাশার সুর ভেসে বেড়ায়। সব হারানোর হাহাকার গ্ৰাস করে ছিন্নমূল মানুষ গুলোকে। দেশভাগের কুপ্রভাবে বাঙলা ক্রমশ ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এরই মাঝে গোটা দেশ জুড়ে চালু হয়ে গেল গণতান্ত্রিক কাঠামোর মোড়কে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। কেন্দ্র, রাজ্য পুনর্গঠনের পাশাপাশি “স্পেশ্যাল স্টেটাস” পেল কাশ্মীর। তাকে ঘিরে জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছিল চরম অশান্তি। ঘোষিত হল বেশ কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক সুস্থিতি ও শান্তি রক্ষার জন্য পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল একদা যৌথ সংসারে থাকা আপন ভাই পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। এতেও তাদের মনে শান্তি এলো না। মূল কারণ হয়ে উঠলো অর্থনৈতিক শোষন বা রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ব্যবস্থা এবং দেশীয় মিলিটারি সিস্টেম-এর প্রত্যক্ষ অপপ্রয়োগ। পূবের মূল্যবান কৃষিজ ফসল থেকে বয়ন শিল্পের মাধ্যমে অর্জিত সিংহভাগ অর্থ পশ্চিমে পাঠাতে হতো। এরই সঙ্গে ভাষা নিয়ে শুরু হয়েছিল তীব্রতর দমন পীড়ন ও চরম অত্যাচার। চাপিয়ে দেওয়া উর্দুকে মেনে নেবে না বাঙলা ভাষাভাষী মানুষ। আর এই মায়ের ভাষাকে কেন্দ্র করে ঠিক এইখান থেকেই শুরু হয়ে গেল চরম ভাতৃঘাতী লড়াই। কত শত অগণিত বাঙলাপ্রেমী মানুষ রক্ত দিয়ে শহীদ হলেন। এপার ওপার বাঙলা হয়ে উঠেছিল সংগ্ৰামময় এক রণাঙ্গণ। এক অখন্ড বাঙলা ভেঙে নতুন করে জন্ম নিল পূর্ব বাঙলা কিম্বা আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ। বাঙলাভাষীদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈরিতার বীজ বপন হয়েছিল এক আগ্ৰাসী মানসিকতা ও জাতক্রোধের হিংসা থেকে। “তুষের আগুন”-এর মতো ধিকিধিকি করে আজও জ্বলছে অসন্তোষ আর চাওয়া পাওয়ার আগুন। বর্তমান কাঠামোর নয়া ভারতের একমাত্র বিরোধিতা করাই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের।

অগণিত ছিন্নমূল পরিবার ও তাদের পরিজন বাঙলার নানা প্রান্তে ডেরা বাঁধলো শুধুমাত্র শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জেলা বাঁকুড়াতেও গড়ে উঠলো উদ্বাস্তু কলোনী। রুখাসুখা বাঁকুড়ার নানা প্রান্তে উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষজন গড়ে তুললো এক একটি ছোটখাটো বাঙলাদেশ। নদী-নালাময় আর সবুজ দেশের এই সহজ সরল অগণিত মানুষ কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্যের উপর ভর করে মাথা তুলে দাঁড়াতে মরীয়া হয়ে উঠলো। কায়িক শ্রমের বিনিময়ে ঘরবাড়ি, ক্ষেতখামার গড়ে তুললো নিজেরাই। সরকার দিয়েছিল পাট্টা নামের সামান্য পরিমাণ জমিজিরেত সহ বাস্তুভিটে। থিতু হয়ে কিছুদিন পরই কঠোর দৈহিক শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতায় তারা ডুবে গেল সংঘবদ্ধভাবে। কোথাও মানাচর, বাঙাল পাড়া আবার কোথাও এক নম্বর, দু’নম্বর ক্যাম্প নামে পরিচিতি ও মর্যাদা পেয়ে গেল। এই গ্ৰামের চাটুজ্যে জমিদার বাড়ির বদান্যতায় প্রায় এক দেড়শো শরণার্থী পরিবারের ঠাঁই হয়েছিল রাজারডাঙা মৌজায়। এই বাঙলাদেশি পরিবারগুলোর কৌলিন্যে সেদিনের রাজারডাঙা আজ বাঙালপাড়া নামেই বিশেষ ভাবে পরিচিতি পেয়েছে। চাটুজ্যে বাড়ির বড় তরফের কর্তাবাবু কয়েকটি শর্ত আরোপ করে প্রত্যেক পরিবারকে বিলি বন্দোবস্ত করেছিলেন  চাষজমি ও কয়েকটি পুকুর। ইজারা বাদ দিয়েও বাঙাল পাড়ার মানুষ সারা বছর জুড়ে জমিদার বাড়ির পূজা-পার্বণে, উৎসব অনুষ্ঠানে জোগান দেয় নানান সামগ্ৰী ও উপাচার। তারাও একাত্ম হয়ে অংশ নেয় জমিদার বাড়ির প্রতিটি উৎসবে। জমিদার বাড়িও নিশ্চিন্ত থাকেন তাদের এই দায়িত্ব কর্তব্য পালনের জন্য। বলির চালকুমড়ো, আখ, জামির থেকে হোম যজ্ঞের দুধ, দই, ঘি এমনকি কাঁচা আনাজ থেকে পুকুরের মাছও পাঠায় প্রয়োজন মতো।

আজ নেই নেই করে সাতাত্তর বছর গড়িয়ে গেল এই মনুষ্যত্ব ও বিবেকের বন্ধন। জমিদার বাড়ির সাহচর্যে ও সহায়তায় বাঙাল পাড়ার বহু ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের পর সরকারি, বেসরকারি দফতরে বিভিন্ন পদে কর্মরত ও প্রতিষ্ঠিত। এই কলোনির বহু ছেলেমেয়ে জমিদার বাড়ির ব্যবসা বানিজ্য, নানান প্রতিষ্ঠানে ও ছোট মাঝারি কারখানা সহ বিভিন্ন ফার্মে কর্মরত। দেশভাগের অভিশাপ ভুলে তারা আজ নতুন আলোর মুখ দেখতে পেয়েছে এই চাটুজ্যেদের অকৃপণ সহায়তায়। বিনিময়ে তারাও অটুট রেখে চলেছে সম্পর্কের এই দৃঢ় বন্ধন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গ্ৰাম জনপদগুলোর সার্বিক উন্নয়ন ও আমূল ভূমিসংস্কারে মন দিল কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকার। বাঙলার উন্নয়নের স্বার্থে জমিদার বাড়ির বড়কর্তা বাবু চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়ের ডাক পড়লো বিধান পরিষদে। বাংলার জনপ্রিয় ও জনচিত্তজয়ী মূখ্যমন্ত্রীর ডাকে তিনি কলকাতায় গেলেন। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠার পরপরই এলো গ্ৰামোন্নয়নের বিভিন্ন কর্মসূচি ও পরিকল্পনা। বাবু চন্দ্রশেখর ছিলেন ব্রিটিশ পোষিত জেলা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। তাঁর ছিল কাজ করার বিরল অভিজ্ঞতা। মূখ্যমন্ত্রীর তলব পেয়ে কলকাতায় যৌথ আলোচনা সেরে ফিরলেন তাঁর নিজের গ্ৰামে। সরকারিভাবে শুরু হয়ে গেল সার্বিক উন্নয়নের কর্মসূচি। পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন কর্মসূচি সামনে থেকে তদারকি করছেন সরকারের বিভিন্ন জনাধিকারিক ও বাবু চন্দ্রশেখর।

চাটুজ্যে বাড়ির আটচালায় বসতো জনশুনানি ও তলবিসভা। একদৃষ্টিতে চন্দ্রশেখর বাবুর নাতি দেখছে তার বড় দাদুর তৈলচিত্র। দেওয়ালে টাঙানো আছে তাঁদের পরিবারের বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের অয়েল পেইন্টিং, ফ্রেস্কো সহ নানা সাইজের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। সদর দরজার মাথার উপরের দেওয়ালে হরিণ, বাইসনের শিং, চিতা ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া সাঁটানো রয়েছে। আভিজাত্যের প্রকাশ যেন ঝরে পড়ছে আটচালা থেকে বৈঠক খানা জুড়ে। রয়েছে সিংহাসনের মতো মূল্যবান কাঠে নির্মিত কয়েকটি কুর্সি ও সূক্ষ্ম নকশা তোলা কাঠের আরামকেদারা। মাঝখানটিতে বার্মাটিকের গোল টেবিল, গরাণ কাঠের জলচৌকিও বিদ্যমান। দুই পাশে দুটো তামাক খাওয়ার গড়গড়া শোভা বর্ধন করে চলেছে। রয়্যাল ইংল্যান্ড কোম্পানির দেওয়াল ঘড়ি জানান দিয়ে চলেছে সময়। নির্লিপ্তভাবে পরিচয় বহন করে তার বনেদিয়ানা আর বহমানধারা। মোগল যুগ থেকে সুবে বাঙলার নবাবি আমল এমনকি ব্রিটিশ কোম্পানির কত পদস্থ কর্মী, রাজস্ব প্রতিনিধি ও সেনা সদস্য এসেছে এখানে তার হিসেব নেই। কোম্পানি থেকে সরকারে পরিবর্তিত হয়েও এই বাড়িতে কত পায়াভারি সাহেব সুবো এসেছে থেকেছে তারও হিসেব নেই আজ। দু’শো বছরের মধ্যে জমিদারির ক্রমক্ষয়িষ্ণুতা তেমনভাবে গ্ৰাস করেনি। জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য ও বৈভব ছিল অটুট। তার প্রমাণ  নুনে ধরা ইঁট কিম্বা ধসে যাওয়া দেওয়াল নজরে পড়েনি কারও।

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version