কথিত আছে যে ছোটবেলায় এসকোবার নাকি তার বন্ধুদের বলতেন, তিনি মিলিয়নিয়ার হবেন। এসকোবার সে কথা রেখেছিলেন। তিনি হতাশও করেননি। কবরস্থানের সমাধি-ফলক, মূর্তি চুরি দিয়ে শুরু করেছিলেন তারপর গাড়ি চুরি, নকল লটারির টিকিট বিক্রি- এ ধরণের অপরাধ। সতেরো বছর বয়সে এই ধরণের অপরাধ ছেড়ে দিয়ে এসকোবার কলম্বিয়ার শহর মেডিলিনের বিভিন্ন প্রতাপশালী মানুষদের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এটা ছিল তার অপরাধ জগতের দ্বিতীয় স্তরে পদার্পণের সোপান। কিডন্যাপিং, র‍্যানসমের পর্ব এখান থেকেই শুরু। এই পর্বে মেডেলিনের এক স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাকে অপহরণ করে এক লক্ষ মার্কিন ডলার বাগিয়ে নেওয়ার পর এসকোবার মেডেলিনের অপরাধীদের কাছে নায়ক বনে যান। এই সময়ে কলম্বিয়াতে সবে মাত্র কোকেনের ব্যবসার শুরু হয়েছে। ততদিনে আমেরিকায় কোকেনের চাহিদা তুঙ্গে। এসকোবার অনেক ভেবে চিন্তে তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেন। কোকেন পাচারই যে তাঁর মিলিয়নিয়ার হওয়ার প্রধান রাস্তা সেটা তখনই বুঝে ফেলেন।

১৯৭৫ সালের কথা, এসকোবার তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কোকেন ব্যবসা শুরু করলেন। বলিভিয়া থেকে কোকা পেস্ট আমদানি করে দুজনে মিলে কোকেন বানানো শুরু করলেন তারপর পুরনো প্লেনের চাকায় সেগুলো ভরে ছোট্ট একটা প্লেনে করে পানামায় পাচার করা শুরু করলেন। এইভাবে প্রতিবার প্রায় ৫ লক্ষ ডলারের কোকেন পাচার হত কিন্তু বিমানবন্দরের অফিসারদেরকে ঘুষ দিতে হতো প্রায় ৩ লক্ষ ডলার। এত কম অঙ্কের লাভ এসকোবারের পক্ষে আর মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না অতএব বেশি লাভের জন্য আরো বড় শিপমেন্ট পাচারের প্রয়োজন হয়ে পড়লো। অন্যদিকে তখনও পর্যন্ত মেডেলিনের কোকেন ব্যবসার অন্যতম প্রধান ছিলেন ফ্যাবিও রেস্ত্রেপো। তাঁকেও এসকোবারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভভ হচ্ছিল না। তাই ফ্যাবিও রেস্ত্রেপোকে সরিয়ে দিয়ে এসকোবার নিজেকে সেই জায়গায় আসীন করলেন। এরপর এসকোবার তিন ওচোয়া ভাইকে নিয়ে গঠন করলেন মেডেলিন কার্টেল। পুরো মেডেলিন শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাকে ‘এল পাদ্রিনো’ অর্থাৎ ‘দ্য গডফাদার’ নামে ডাকা শুরু হলো।

১৯৭৮ সালে মেডেলিন কার্টেল প্রতি মাসে ৩৫ কেজিরও বেশি কোকেন পাচার করত। ১৯৮০ সালের গোঁড়ার দিকে আমেরিকায় হঠাৎ করেই কোকেনের দাম কমে যায়, এতে সাদা পাউডারের জন্য লোকজনের চাহিদা আরো বেড়ে গেল। আর এই চাহিদা পূরণ করার দায়িত্ব নিলেন এসকোবার। কিন্তু সেই কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য দরকার বিরাট এক নেটওয়ার্ক দরকার। এসকোবার দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, পুলিশ অফিসার আর স্থানীয় কর্মকর্তাদেরকে টাকা দিয়ে কিনে নিলেন। এসকোবারের মেডেলিন কার্টেল বলিভিয়া আর পেরু থেকে প্রচুর পরিমাণে কোকা পাতা আমদানি করে সেই পাতা দিয়ে কলম্বিয়া আর ভেনিজুয়েলায় তৈরি করতে লাগলো কোকেন, তারপর সেই কোকেন ক্যারিবিয়ান অথবা মধ্য আমেরিকা দিয়ে ঢুকতও আমেরিকায়। এসকোবার মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে কলম্বিয়াসহ সব জায়গার সরকারি কর্মকর্তাদেরকে মুখ বন্ধ রাখতেন, যারা টাকা নিতে অস্বীকার করতো তারা পেত সীসার বুলেট। এভাবেই এসকোবারের মেডেলিন কার্টেলের স্থানীয় ব্যবসা এক দশকের মধ্যেই আন্তর্জাতিক এন্টারপ্রাইজে পরিণত হয়, সেই সময় মেডেলিন কার্টেলের দৈনিক আয় ছিল ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!

দিনের পর দিন এসকোবারের ক্ষমতা যত বাড়তে থাকে, এসকোবারও বুঝতে পারেন অপরাধ জগতে ক্ষমতা অর্জনের পথ হল দুতি, একটি ভয় আরেকটি সমীহ। এছাড়া মাদক পাচারের জগতে কোনো রকম দয়া মায়ার স্থান নেই। কারণ এই দুনিয়া হল সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। এসকোবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। অনুমান করা হয়, প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার লোকের হত্যার কারণ ছিলেন এসকোবার। তবে খুব বেশিদিন তিনি নিজে আর রক্তে হাত রাঙান নি। সে কাজের জন্য কাজের জন্য দল তৈরি করেছিলেন। এসকোবারের বিপরীতে কথা বলে প্রাণ হারিয়েছিলেন কলম্বিয়ার ৩ জন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, ৩০ জন বিচারক, কয়েক ডজন সাংবাদিক এবং কমপক্ষে ৪০০ জন পুলিশ অফিসারকে। সমাজে তার অবস্থান যা-ই হোক না কেন এসকোবারের শত্রু হওয়ার একমাত্র পরিণতি অকাল মৃত্যু।

কিন্তু এসকোবার বুঝেছিলেন শুধুমাত্র ভয় দেখিয়ে বেশিদিন এই জগতে টিকে থাকা যাবে না। সব গ্যাংস্টারকেই মানুষ ভয় পায়, কিন্তু তাদের জমানা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়না। এসকোবারও বুঝেছিলেন টিকে থাকতে হলে তাকে কলম্বিয়ার সাধারণ মানুষের মন জয় করতে হবে। আর ঠিক সে কারণেই এসকোবার মানুষের মঙ্গল কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। এসকোবার বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট, বিলাসবহুল দ্রব্য আর সুপার কারের পিছনে যেমন প্রচুর খরচ করতেন পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্যও খরচ করেছেন প্রচুর প্রচুর টাকা।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version