পুরো নাম পাবলো এমিলিও এসকোবার গভিরিয়া। জন্ম ১৯৪৯ সালের ১ ডিসেম্বর কলম্বিয়ার এন্টিওকিয়া প্রদেশের রিওনিগ্র শহরে। বাবা করতেন কৃষি কাজ আর মা ছিলেন স্কুল টিচার। এসকোবার ছিলেন তাঁর বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। প্রায়-ইস্কুল থেকে পালাতেন। কোনোদিন শিক্ষকদের সঙ্গে মুখে মুখে তর্কে জড়িয়ে স্কুল থেকে বিতাড়িতও হতেন। স্কুলে পড়ার সময়ে এসকোবারের চুরিবিদ্যায় হাতেখড়ি হয়। তখন থেকেই তিনি গোপনে কবরস্থানের সমাধি শিলা চুরি করে সেগুলিকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করে স্থানীয় চোরাকারবারিদের কাছেবিক্রি করে দিতেন। কবরস্থানের পাথরের মূর্তি চুরি করে সেগুলি স্থানীয় পাচারকারিদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করতেন। ছেলের লেখা পড়া বা স্বভাব চরিত্র নিয়ে বাবা বিশেষ মাথা ঘামাতেন না, তবে তাঁর মায়ের শাসন ছিল কড়া। স্কুল পালানো আর চুরি বিদ্যায় পারদর্শি হয়ে ওঠা এসকোবার তাঁর মায়ের শাসনের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই,বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি আর পার হতে পারেননি। তার আগেই পুরোপুরি জড়িয়ে যান অপরাধ জগতে।

এসকোবারের যখন সাত বছর বয়স, তখন থেকেই তিনি বাড়ি থেকে প্রায় এক ঘন্টা রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতেন।একদিন ঘটনাচক্রে স্কুলে পৌছানোর আগেই তাঁর পায়ের জীর্ণ জুতোটি ছিড়ে যায়। ছেড়া জুতো দেখে স্কুলের দারোয়ান তাঁকে আর স্কুলের গেট পেরতে দেননি। সন্ধ্যা বেলায় তাঁর মা যখন বাড়ি ফিরলেন তখন এসকোবার সে কথা মাকে জানালে তিনি অনেক কষ্টে কিছু টাকা ব্যবস্থা করে ছেলের জন্য জুতো কিনে আনেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখেন দুটি জুতো দুরকম। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ফের সেই দোকানে যান, কিন্তু দোকানদার জুতো ফেরত দেন না।দোকানদারের কথায় মা কেঁদে ফেলেন, মায়ের চোখে জল দেখে ছেলে বলে উঠে “মা তুমি কেঁদো না, আমি বড় হয়ে তোমাকে এই দোকানটাই কিনে দেবো, তুমি যা চাও তাই দেবো”। সেই ছোট্টবেলায় মায়ের কাছে দেওয়া কথা এসকোবার পূরণ করেছিলেন। তিনি এত টাকা রোজগার করেছিলেন যার প্রায় ১০% পরিমাণটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। কারণ বিভিন্ন জায়গায় অসুরক্ষিতভাবে টাকার পেটি লুকিয়ে রাখার জন্য, জল লেগে, পোকা ও ইঁদুরে কাটার ফলে নষ্ট হয়ে যেত সেই টাকা। আক্ষরিক অর্থেই জলে যাওয়া টাকার পরিমাণ নেহাত কম ছিল না, বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার।

এসকোবার তাঁর ড্রাগ ব্যবসা থেকে প্রতিদিন প্রায় ছ’কোটি ডলার রোজগার করতেন। বছরের শেষে সেই রোজগার গিয়ে দাঁড়াত ২০০০ কোটি ডলারে। ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রকাশিত বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায়, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত জ্বলজ্বল করত এসকোবারের নাম। এর মধ্যে ১৯৮৯ সালে, বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় সপ্তম স্থানে উঠে এসেছিলেন এসকোবারে। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ সঠিক ভাবে জানা না গেলেও, অনুমান করা হয় এসকোবারের সম্পত্তির মূল্য ছিল ৩০০০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এসকোবারের কোম্পানি মেডেলিন কার্টেলের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন তাঁরই নিজের ভাই রবার্টো এসকোবার। তাঁর লেখা ‘দ্য অ্যাকাউন্টেন্ট স্টোরি: ইনসাইড দ্য ভায়োলেন্ট ওয়ার্ল্ড অফ দ্য মেডেলিন কার্টেল’ বইটিতে তিনি এমন সব তথ্য দিয়েছেন যা পড়লে হতবাক হয়ে যেতে হয়। এসকোবারের একটি বড় সমস্যা ছিল বিশাল পরিমাণ নগদ টাকা। আর সেই নগদ নিয়ে প্রতি মাসে এসকোবার সমস্যায় পড়তেন।ওই পরিমাণ নগদ টাকা ব্যাঙ্কে রাখার প্রশ্নই ছিল না। আবার প্রত্যেক মাসে তাঁর আস্তানায় জমা হওয়া প্রায় ২০০ কোটি ডলারের নোট পুলিশের নজরদারির জন্য সরাতেও পারতেন না। ফলে কোটি কোটি ডলারের নোট বোঝাই পেটিগুলি কলম্বিয়ার বিভিন্ন কৃষি জমি, পরিত্যক্ত পাম্প ঘর, মেডেলিন কার্টেল-এর মেম্বারদের বাড়ির দেয়ালে গর্ত করে লুকিয়ে রাখতে হত।

ক্ষমতার চূড়ায় থাকা অবস্থায় এসকোবারের মেডেলিন কার্টেল বিশ্বের ৮০ ভাগ কোকেন পাচার নিয়ন্ত্রণ করতো। আর সেই কোকেন পাচারচক্র সম্রাটের আচরণ ছিল যেমন বর্বর তেমনি পাশবিক। কোনও শত্রুই এসকোবারের হাত থেকে নিস্তার পেত না। তিনি মাদক ব্যবসায়ী হন কিংবা সাংবাদিক অথবা সাধারণ মানুষ, যে তাঁর বাধা হয়ে দাঁড়াতো, তাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওটাই ছিল রীতি। রাজনীতিবিদ আর পুলিশকে দেওয়া হত মোটা টাকা ঘুষ। এসকোবারের স্ট্র্যাটেজি ছিল, ‘প্লাতা ও প্লোমো’ অর্থাৎ, ‘টাকা অথবা সীসা’। টাকা নাও তা না হলে বুলেট নিয়ে ওপারে চলে যাও। তবে এসকোবার তাঁর কালো টাকা অকাতরে বিলিয়ে দিতেন কলম্বিয়ার গরীব মানুষদের।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version