ফ্রান্সে তৃতীয় নেপোলিয়নের শাসনে চিত্রকলা জগতের নিয়ন্ত্রণ ছিল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের হাতে। তাদের নিয়ম অনুযায়ী ছবি হবে ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও পুরাণভিত্তিক। গুরুত্ব পেত না ল্যান্ডস্কেপ ও স্টিল লাইফ। সেই ছবিও অ্যাকাডেমি পরীক্ষাকরে দেখত ব্রাশস্ট্রোক ঠিকমতো হয়েছে কি না, গোল্ডেন ভার্নিশ করা হয়েছে কি না ইত্যাদি। তারপর বছরের একমাত্র প্রদর্শনী স্যালন দ্য প্যারিসে সেই ছবিগুলি প্রদর্শিত হত, তাতেও থাকতো অ্যাকাডেমির নিয়ন্ত্রণ। যদিও স্যালনে নির্বাচিত ছবির শিল্পী সম্মান, পুরস্কার, এমনকি টাকা-পয়সাও পেতেন। সব শিল্পী তাই অ্যাকাডেমির নিয়ম মেনে ছবি আঁকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আঠারো শতকের ছয়ের দশকের কয়েকজন তরুণশিল্পী অন্য কথা ভাবলেন। ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, পুরাণ তো নয়ই এমনকি স্টুডিওতে বসে স্কেচের উপর গতানুগতিক রঙ দিয়ে ছবিআঁকতে তাঁদের মন সাড়া দিল না। খোলা আকাশের নিচে বসে উজ্জ্বল রঙে তাঁরা আঁকলেন ল্যান্ডস্কেপ ও স্টিল লাইফের ছবি। কিন্তু সেই ছবি তাঁরা স্যালনে প্রদর্শনীর জন্য জমা দিলে বিচারকমণ্ডলী বেশিরভাগ ছবি ‘প্রদর্শনীর অযোগ্য’ বলে বাতিল করে দেয়। এর বেশ কয়েক বছর পর তাঁরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ছবির প্রদর্শনী করতে ‘কো-অপারেটিভ অ্যান্ড এননিমাস অ্যাসোসিয়েশন অফ পেইন্টারস, স্কাল্পটরস অ্যান্ড এনগ্রেভারস’ নামে একটি সংগঠন গড়েন। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অগাস্ত রেঁনোয়া, ক্যামিই পিসারো, পল সেজান, আলফ্রেড সিসলে, ইউজিন বুঁদো, গিওম বার্থা মরিসট এবং ক্লদ মনে। ওঁদের প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৮৭৪ সালে।

এই ঘটনার বছর দুই আগে ক্লদ মনে একটি সুর্যাস্তের ছবি আঁকেন। প্রথম দেখায় ছবিটি যে কারো কাছেই অতি সাধারণ মনে হয়। কারণ ছবিটি হল নদী, ভাসমান নৌকা, ভোরের সূর্য ওঠা, নদীর জলে তার প্রতিফলন, সবই আভাসমাত্র। ছবিতে সূর্য ও জলের প্রতিফলনে ফিকে নীল ও কমলা রং ব্যবহার করা হয়েছে। ফিকে কমলা রং দেওয়া হয়েছে। তখনকার শিল্পরীতির কোনো ধরণই এই ছবিতে ধরা পড়েনি। প্রায় গোটা ছবিটাই অপ্রচলিত এবং ব্যতিক্রম ধরনের। আসলে তখনকার শিল্পজগতের স্বীকৃত কোনো স্টাইল এই ছবিতে ব্যবহৃত হয়নি। ক্লদ মনের আঁকা ‘ইম্প্রেশন সানরাইজ’ নামের ছবিটি সেই প্রদর্শনীতে দেখানো হয়।লা কারিভারি পত্রিকায় ওই চিত্র সমালোচক লুই ল্যরি প্রদর্শনী সম্পর্কে ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করে ‘দ্য এক্সিবিশন অভ ইমপ্রেশনিস্টস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ক্লদ মোনের ইমপ্রেশন, সানরাইজ ছবিটি সম্পর্কে লুই ল্যরি বলেন, এটি একটি খসড়া ছাড়া কিছুই না। কিন্তু লুই ল্যরির ‘ইমপ্রেশনিস্ট’ কথাটি খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শিল্পীরাও তার দেওয়া ওই নামতি সাদরে গ্রহণ করেন।

সমালোচক ও দর্শক কেউই সেদিন তাঁদের প্রদর্শনীর ছবিগুলিকে প্রশংসার চোখে দেখেননি। বরংছবিগুলি নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলতে থাকেন যে, কোনো পোকার পায়ে রং মেখে কাগজের উপর ছেড়ে দিলে এর চেয়ে হাজার গুণ ভালো ছবি আঁকা হয়ে যাবে! তবে ক্লদ মনের নদীতে উদীয়মান সূর্যের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠার রংয়ের দিকে তাকালে মনে হয়, ভোরের সূর্য ও তার প্রতিফলন যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। শিল্পী যখন তার ছবিতে আলোর কোনো উৎস সে চাঁদ কিম্বা সূর্য আঁকেন,  তখন তাঁর পক্ষে সত্যিকারের আলো ব্যবহার সম্ভব হয় না। আলোর দৃশ্য তৈরি করতে তাঁকে রং তুলির সাহায্যই নিতে হয়। তাঁকে ব্যবহার করতে হয় দৃশ্যের চারপাশে ব্যবহার করা রঙের নিখুঁত ও সার্থক টোন। আলোর উৎস হিসেবে সূর্য আঁকলে আলোর তীব্রতা অনুযায়ী রঙের ব্যবহার করতে হয়। সেক্ষেত্রে সূর্যের উজ্জ্বলতা ও নদীর জলের প্রতিফলন তুলে ধরতে রঙের গাঢ় ও হালকা টোন পাশাপাশি ব্যবহার করা।

ক্লদ মনের ‘ইম্প্রেশন সানরাইজ’ ছবিটিতে ব্রাশের ব্যবহার দেখলে সহজেই বোঝা যায়, ব্রাশ ব্যবহারে সূক্ষতাকে যথা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তার বদলে মনে নদীতে সূর্যের প্রতিফলন ও নৌকা আঁকার ক্ষেত্রে তুলির ছোট ছোট টান ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে নৌকার দৃশ্যে মোটা ব্রাশ ব্যবহারে তার পারদর্শিতা ফুটে উঠেছে। সেই সময় ছবি আঁকার কৌশল হিসেবে যেটি কেবল অভিনবই নয়, রীতিমতো বিস্ময়কর ও ইতিহাস তৈরি করার মতো। নদীতে সূর্যের আলোর প্রতিফলনেও রয়েছে অভিনবত্ব। খেয়াল করলে বোঝা যায়এমন একটি দৃশ্য রচনা করতে কেবল কমলা রঙের ব্যবহার নয়, রঙের উজ্জ্বলতা বাড়াতে কমাতে অতি সূক্ষ ভাবে সাদা রঙ ব্যবহার করেছেন।নদীতে ভাসমান নৌকা ও দিগন্তে আকাশের আভাস হিসেবে গাঢ় সবুজ ও নীল রং ব্যবহার করেছেন। যে কারণে আলোর প্রতিফলনক্ষেত্র বিশেষে উজ্জ্বল ও ম্লান হয়ে ফুটে উঠেছে। বোঝা যায়, জলে আলোর প্রতিফলন ও তার বিজ্ঞান সম্পর্কে ক্লদ মনের ধারণা ছিল স্পষ্ট। সে কারণেই ল্যান্ডস্কেপ আঁকার প্রথাগত পদ্ধতি সরিয়ে দিয়ে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

চিত্রকলায় ইম্প্রেশনিজমের পথিকৃৎ ক্লদ মনের ইম্প্রেশন সানরাইজ থেকেই ইম্প্রেশনিজম আন্দোলনের শুরু। ইম্প্রেশনিজম কথাটির আক্ষরিক বাংলা প্রতিচ্ছায়াবাদ। যার একটি অর্থ ইঙ্গিতে ছবি আঁকা। আরেকটি অর্থ ছবিগুলি কখনোই যথাযথ আকৃতিতে আঁকা নয়। বদলে কল্পনায় যে রূপ ধরা দেয় তা মূর্ত হয় ছবিতয়ে।কিন্তু প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ফুটে ওঠে ছবির মূল বিষয়বস্তু।ইম্প্রেশনিস্টরা তুলির আচর দেন খুব দ্রুত। বিষয়কে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলাটা এখানে মুখ্য নয়, আলো ও রঙের খেলা যেন হৃদয়ে বেশি অনুভূত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিশ-শতকের শুরুতে মনে একের পর এক মাস্টারপিসে নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। সেই সঙ্গে সিরিজ-পেইন্টিংস। একই দৃশ্যের ছবি বিভিন্ন ঋতুতে, দিনের বিভিন্ন সময়ে, সূর্যের আলোর বিভিন্ন কোন থেকে তিনি এঁকেছেন অসামান্য দক্ষতায়।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version