‘আজ চড়ক। ...চড়কগাছ পুকুর থেকে তুলে মোচ বেন্ধে মাথায় ঘি-কলা দিয়ে খাড়া করা হয়েছে, ক্রমে রোদ্দুরের তেজ পড়ে এলে চড়কতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো। …চড়কতলায় টিনের ঘুরঘুরী, টিনের মুহুরী দেওয়া তলতা বাঁশের বাঁশী, হলদে রং করা বাঁখারির চড়কগাছ, ছেঁড়া ন্যাকড়ার তইরি গুড়িয়া পুতুল, শোলার নানা প্রকার খেলনা, পেল্লাদে পুতুল, চিত্তির করা হাঁড়ি বিক্রি কত্তে বসেছে। … একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুঁড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়কগাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লে-মৈয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া হতে লাগলো, সকলেই আকাশপানে চড়কীর পিঠের দিকে চেয়ে রইলেন। চড়কি প্রাণপণে দড়ি ধরে কখন ছেড়ে পা নেড়ে ঘুরতে লাগল। ‘দে পাক দে পাক’ শব্দ কারু সর্ব্বনাশ কারু পৌষমাস।’

চড়কের এই বর্ণনা পাই হুতোম-এর নকশায়।বলা বাহুল্য এই বর্ণনা প্রাচীন কলকাতার চড়কের। অনেক পরে গ্রাম বাংলার চড়ক মেলার প্রসঙ্গ এসেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’ তে। অপু কাহিনিতে বিভূতিভূষণ চড়ক মেলা লেখেন, ‘…চড়কতলার মাঠের শেওড়াবন ও অন্যান্য জঙ্গল কাটিয়া পরিষ্কার করা হইয়াছে…’  সে চড়কে অপু-দুর্গা গাজনের সন্ন্যাসীদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াত। গ্রামের ওই বারোয়ারি চড়কে হরিহর এক টাকাচাঁদা দিয়েছিলেন। চড়কে অপুদের গ্রামে যাত্রা আসত। সে বার এসেছিল নীলমণি হাজরার যাত্রা। এর ঠিক পরেই হরিহর অপু সর্বজয়াকে নিয়ে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়েছিল। ফের  চব্বিশ বছর পর চৈত্রের শেষে অপু ছেলের হাত ধরে নিশ্চিন্দিপুর ফিরেছিল।তার পরের দিন বিকেলেই চড়ক। অপু তার গ্রামের চড়কের মেলায় হাজির হয়।সন্ধে হয়ে গিয়েছে। অপু দেখল, চড়কের মেলা দেখে হাসিমুখে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে ছেলের দল। কারও হাতে বাঁশের বাঁশি, কারও হাতে মাটির রং করা পালকি। তবু অপুর মনে হয়েছিল ছোটবেলার সেই চড়কের মেলাটা কেমন পালটে গিয়েছে।

চড়ক বলতে সাধারনভাবে চক্র বা ঘুর্ণনকেই বোঝায় কিন্তু ওই ঘুর্ণন যে কী ভয়ঙ্কর বা সাঙ্ঘাতিক তা যারা চড়কের ছবি দেখেছেন তারাও জানেন। কিন্তু চামড়ায় বাণ-বঁড়শি বিঁধিয়ে ঝুলে থেকে ঘোরার কারণটা কী? অনেকেই অনেক কারণের কথা বলেন। কেউ ভারতীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির দিন সূর্যের যে অয়ন বা যাত্রা শুরু হয়, সেই আবর্তনের ছাপ লক্ষ্য করেছেন। যাই হোক না কেন, আসলে এটি একটি লোকউৎসব। ভূমিকেন্দ্রিক সভ্যতার এই  দেশে ফসলের উর্বরতা প্রার্থনা থেকে এই পুজোর উৎপত্তি বলে উল্লেখ আছে। উর্বরতা শুধু জমিতে নয়, ঘরেও। যে কারণে চড়কের গাছ যে আঙ্গিকে পোঁতা হয় তা পুরুষাঙ্গের আকৃতি বলেই ধরা হয়। এ জন্য চড়ক গাছ যেদিন পুকুর থেকে ওঠানো হয় সেদিন যেসব বিবাহিত মহিলাদের সন্তান হয় না তারাওই পুকুরে স্নান করেন সন্তানের আশায়। আর চড়ক ঘোরার বিষয়টি চান্দ্র মাসের পরিচয় বহন করে।

আধি পুরাণের বর্ণনায় আছে, রাজা দক্ষের এক কন্যা ছিল চিত্রা। তার নামানুসারে এক নক্ষত্রের নাম করা হয় চিত্রা। নক্ষত্র চিত্রা থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ। তাই হিন্দু ধর্মে চৈত্র মাসের বিশেষ স্থান। চৈত্র মাসের শেষ দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বসে বিধাতাকে তুষ্ট করার নানান আয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে অভিনব ও প্রাচীন আয়োজন চড়ক পুজো, সেই সঙ্গে মেলা। চড়ক পুজোর ১০-১২ দিন আগে থেকে বিভিন্ন এলাকার পূজারিদের মধ্যে ৪০-৫০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরীসহ নৃত্যগীত করে মাগন করেন। চড়ক পূজা পর্যন্ত তারা পবিত্রতার সঙ্গে সন্যাসব্রত পালন করে ও নিরামিষ খায়, সারা দিন উপবাস পালন করে।

চড়ক পুজোর ২ দিন আগে থেকে পূজারিরা শ্মশানে গিয়ে পুজো-অর্চনা করে ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে গোটা এলাকা প্রদক্ষিণ করে। চৈত্র মাসের শেষ দিন পূজারিরা পুজো করে পান বাটা দিয়ে চড়ক গাছকে নিমন্ত্রণ জানায়। দিঘি বা পুকুর  থেকে  চড়কগাছ তুলে আনা হয়।তারপর মাঠে গাছ পুঁতে দেওয়া হয়। গাছের চূড়া থেকে প্রায় কোমর পর্যন্ত আড়াআড়ি চারটি পাখার মতো করে বাঁধা হয় চারটি মোটা বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় মোটা-লম্বা দড়ি। এই সময় শিব ও কালীর নৃত্য হয়। নৃত্য শেষে ওই পুকুর বা দিঘিতে স্নান করে সন্যাসীদের জিব ও নাকে গহনা গেঁথে দেওয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়কগাছ ঘোরানো হয়। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে দুপুরে মূল সন্যাসী চারজনের (কখনও এক বা দুজন) পিঠে লোহার দুটি বড়শি গেঁথে দড়িতে বেঁধে চড়ক গাছে ঝুলিয়ে ঘোরানো হয়।

চড়ক পুজো মূলত নীল পুজো নামেই পরিচিত। গম্ভীরা বা শিবের গাজন এই চড়ক পুজোরই রকমফের। চড়ক পুজো চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। পতিত ব্রাহ্মণ এ পুজোর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পুজোর বিশেষ অনুষঙ্গ হল শিবের পুজো। একটা সাজানো কাঠ তাতে লালসালু প্যাঁচানো, সিঁদূর মাখানো থাকে মাথার দিকটায়। এই পাট বা শিবকে একজন মাথায় নেয় আর বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এর সামনে কোন গর্ভবতী মহিলা পড়লে তার বিপদের আশঙ্কা থাকে বলে মনে করা হয়।

এসব পুজোর মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত ছিল।এই পুজোতে বা উৎসবে বহু ধরনের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্যাসীকে লোহার হুড়কো দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিবে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো  লোহার শলাকা তার জিভে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত রয়েছে। আধুনিকতার অভিঘাতে ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলির চারিত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। তারপরও মেলা শ্রেণিহীন উৎসব। এর কোনো বিকল্প নেই। গ্রাম বংলার মেলার এই আবেদন মনে হয় শেষ হওয়ার নয় কখনো।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version