নিয়নের আলো জগৎসংসারকে গ্রাস করে নিলে, আমি আঁধারের কাছে দুহাত পেতে রাখি। বিন্দু বিন্দু আঁধার কণা এসে জমাট বাঁধে শিশির ভেজা করতলে। আঁধারের ঠোঁট ছুঁয়ে শনশন করে হাওয়া বয়। ধোঁয়া ধোঁয়া মাঠঘাট ভরে যায় অজস্র জোনাকির অস্ফুট আহ্ললাদে। ফোঁটা ফোঁটা জোনাকির আলোয় ভুবন হাতড়ে ঠিক ছুঁয়ে ফেলি উত্তাল কৈশোর। ফিরে যাই কৈশোরের পাঠশালার কোলাহল মুখর ক্লাসঘরে।

হেঁটো ধুতি পরা সেই সব দিনের মাস্টারমশাইরা সার বেঁধে বসে থাকেন থুড়থুড়ে অশ্বত্থের শীতল ছায়াতলে। লকলকে বেত কবে খসে পড়ে গেছে শিথিল মুষ্টি থেকে। তথাপি কাঁপা কাঁপা হাতে ধুলোবালি দিয়ে মহাকালের কপালে আজও গেঁথে চলেছেন মানুষ গড়ার সোপান। চোখের পাতায় এসে আটকে যায় কৈশোরের মেঘলা ক্লাসঘর। কালো বোর্ডের সামনে সাদা চক হাতে বিশ্ব চরাচর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন জমা রাখা আছে ওই কালো বোর্ডের কালান্তরি হেপাজত খানায়।

সেদিন কি পড়াচ্ছিলেন যেন স্যার! ও হ্যাঁ, কাবুলিওয়ালা। ব্যাখ্যা করে চলেছেন ছোট্ট মিনির সাথে কাবুলিওয়ালার নিত্য খুনসুটির কথা। বলতে বলতে মাস্টারমশাইয়ের চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সেদিন থেকে দশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আদুরী সন্তানের কচি মুখখানি ভেসে ওঠে কালো বোর্ডের আত্মায়! স্যার পকেট থেকে রুমাল বের করেন। চোখের পাতায় হঠাৎ জেগে ওঠা মুক্তবিন্দুগুলো রুমালের জোব্বায় আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মাস্টারমশাই আবার বলে চলেন।

কোথা থেকে যেন জলবিন্দু ঠাসা টলটল মেঘ ঢুকে পড়ে ক্লাসঘরের কানায় কানায়। বনবাদাড় উজাড় করে এক ঝাঁক উদাসী বাতাস তখন ক্লাসঘরময়। সেদিন ঝড় ওঠেনি কোথাও। বৃষ্টিও নামেনি কোথাও ভুবন জুড়ে। মুঠোয় জোনাকি ভরে আমরা সবাই স্বজন হারানোর অব্যক্ত যন্ত্রণার সুরে বাকশক্তিহীন। ঠিক তখনই বৃষ্টি নামলো এক ঘর দুরুদুরু কৈশোরের চোখের পাতায়!    

নিয়নের আলোর চোখ রাঙে যতো, আঁধারের কাছে ঋণ বাড়ে ততো। কুয়াশা ঝুলে থাকা পুকুরের জলে লাফিয়ে নামে বিষাদ। অন্ধকার ফুঁড়ে হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জন্মান্তরের বাতাস। বড় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। ঝরা ফুলের পাপড়ির মতো উড়তে থাকা মায়া সরণির নিস্তব্ধ অন্তরঙ্গতার কাছে। ফিরে যেতে চাই অবচেতনের কাছে গচ্ছিত রাখা ছোঁয়াচ লাগা বাল্যপ্রেমের ছায়াতলে।

Abstract art background. Modern art . Multicolored bright texture. Oil painting .

কেউ একদিন বলেছিল। কৃষ্ণচূড়ার আলো জ্বেলে অন্তহীন পথ পাশাপাশি হেঁটে চলার কথা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কালো মেঘে আঁধার নেমে এসেছিল। সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রনির্ঘোষ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির তরঙ্গায়িত মায়া। লাজুক কাজল লতার আকাশ ভেঙে। ভিজে একশা মন। থমকে যাওয়া রক্তস্রোত। ছেড়ে যাওয়া হাত। উতলা বাতাস। সেই আলো নিভে গেছে কবে! তবু তাঁর বুকে লুকোনো দগদগে দাগ, আজও জ্বলে আছে গুঁড়ো কুয়াশার অন্তরালে।

জীবনের পাকদণ্ডী পথ ক্রমশ সংকুচিত হয়। তবু মায়া বেঁচে থাকে। মাঠে, ঘাটে, পদ্মপুকুরে জল মাকড়শার কাটা হিজিবিজি কক্ষপথে, দোয়েলের নিশিযাপনের খড়কুটোময় আস্তানায়। জীবনের কড়িবর্গার গায়ে যতো মেঘের স্তর এসে জমাট বাঁধে, ততোই কালবৈশাখীর মতো আছড়ে পড়ে জন্মান্তরি মায়া।

মায়ার আঁচলে শরীর ভিজিয়ে অবসন্ন জীবন হেঁটে চলে আলপথ ধরে ধানক্ষেত ভেঙে। সোনালী দিগরের কাছে জমা থাকে সোনা রঙের স্মৃতির বাক্সটা। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা সোনালী শস্যের গাল বেয়ে চলকে পড়ে সোনা রোদ্দুর। অনেকটা আলোছায়াময় পথ হাঁটা হল। আরও কিছু ঝাপসা পথ হাঁটা বাকি এখনও। আলের ওপর সকল আলস্য ঢেলে ঝিমিয়ে থাকে বিষাক্ত গোখরো। দুহাতে শিশির মেখে উন্মুক্ত প্রান্তরে কারা যেন আজও ফিসফাস করে। অব্যক্ত প্রেম আদিগন্তের ঠিকানায় আকাশপ্রদীপ জ্বেলে রাখে।

দুর্মর ভালোবাসা ক্লান্তিহীন পথ হেঁটে চলে আলোআঁধারি দিগন্ত পানে।

লেখকঃ অধ্যাপক, সমাজ, রাজনীতি ও পরিবেশ বিশ্লেষক

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version