‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দো কেনে?’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যয়ের কবি উপন্যাসের নিতাই যে রঙ নিয়ে গান বেঁধেছিল সেই রঙ নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যত কথা, তার আড়ালে যত দ্বন্দ্ব, তত অবহেলা। আমরা কালো নিয়ে তাচ্ছিল্য অবহেলা করলেও অসিত, অসিতবরন নামকরণে আপত্তি থাকে না। অনেকে আবার ভালবাসায় কালীকৃষ্ণ থেকে কালী, কালো, কাল্টুও হন। এই নামকরণ অবশ্য সাদা-কালোর হিসাবনিকাশের পাল্লায় হয়নি। তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ফরসা হওয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপনে যেমন তারকাদের মুখ দেখা যেত তেমনি প্রসাধনী দোকানে বিপুল পরিমাণে বিক্রিও হত। এখন ফর্সা হওয়ার বদলে বলা হচ্ছে ত্বক উজ্জ্বল করার ক্রিম। তার মানে বর্ণবৈষম্য মনের কোনে থেকেই গিয়েছে। আমাদের সিনেমা জগতে বর্ণবৈষম্য বহুকাল আগে থেকেই ছিল। সেই বৈষম্যের কাছে হার মানতে হয়েছে বহু মেধাবী ও যোগ্য অভিনয় শিল্পীকে। কেউ কেউ এই রঙের বাছবিচারের কাছে হার মানেননি। তাঁদের মধ্যে অভিনেত্রী স্মিতা পাতিল অন্যতম। গায়ের রঙের কারণে তাঁকে যে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে সে কথা অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের মানসিকতাই সবথেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন। এখনো আমরা সৌন্দর্য বিচারে প্রথমেই ফর্সা রঙকে প্রাধান্য দি। স্মিতা পাতিল রঙের বিষয়ে ছিলেন আপসহীন। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই তাঁকে অনেকবারই গায়ের রং নিয়ে নানা আপস করতে বলেছিলেন। কিন্তু স্মিতা তা কখনোই করেন নি। তার ব্যক্তিত্বেই ছিল এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের ছাপ। যা ইন্ডাস্ট্রির সনাতন ভাবনাকে ভেঙেচুরে দিয়েছিল।

কালো মেয়েটি একদিন সংবাদ পাঠিকা হিসেবেও দর্শকদের নজর কেড়েছিল। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিদীপ্ত সৌন্দর্য দেখেই শ্যাম বেনেগল তাঁর ‘চরনদাস চোর’ ছবির জন্য স্মিতাকে নির্বাচন করেন। প্রসঙ্গত, এর আগে স্মিতা অরুন খোপকারের ডিপ্লোমা ফিল্প ‘Teevra Madhyam’-এ অভিনয় করেছিলেন। স্মিতার বাবা মা কেউই খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবু ছোটদের ছবি ভেবেই তাঁরা সম্মতি দেন। কিন্তু তাঁদের মত বদলে যায় ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর। ছবিতে রানীর ভূমিকায় স্মিতাকে দেখে তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে মেয়েকে ছবিতে অভিনয় করতে দিয়ে তাঁরা কোনও ভুল করেননি। পরের ছবি ‘নিশান্ত’-এর জন্য শ্যাম বেনেগলের পছন্দ স্মিতা। কিন্তু এবার বাধা স্মিতার কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি কিছুতেই বিএ পরীক্ষার তিনমাস আগে স্মিতাকে হিন্দী ছবিতে অভিনয় করতে দিতে রাজি নন। পরিচালক তাঁকে ‘নিশান্ত’ যে ঠিক গড়পড়তা সিনেমা নয়; বোঝাতে পেরেছিলেন। ছবি মুক্তির পর সেন্ট জে়ভিয়ার্সের অধ্যক্ষও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন যে এমন ছবির জন্য কিছু ক্লাস বাদ দেওয়া যেতেই পারে।

শ্যাম বেনেগলের ‘ভূমিকা’য় স্মিতা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পরিচিত স্মিতা একের পর এক মূলধারার ছবির জন্য ডাক পেতে থাকলেন। কিন্তু স্মিতা তখন মুম্বাইয়ের হিন্দী ছবির নায়িকা হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। নারীবাদী স্মিতা কিছুতেই সিনেমায় ভারতীয় নারীদের দুর্বল দেখানোর কোনও মাধ্যমকে মন থেকে মেনে নিতে পারতেন না। তাই তিনি তথাকথিত বাণিজ্যিক হিন্দী সিনেমার মুখ হয়ে উঠতে চাননি। তাঁর মত ছিল, নারীর জীবনসংগ্রামকে ছোট করে দেখিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছবিকে তুলে ধরাই যে ছবির উদ্দেশ্য সেখানে তিনি কিছুতেই অভিনয় করবেন না।

অবশ্য পরবর্তীতে ‘মন্থন’, ‘আক্রোশ’, ‘সদগতি’, ‘চক্র’ ছবির স্মিতা ‘শক্তি’, ‘নমকহালাল’ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেন পাশাপাশি ‘মন্ডি’, ‘বাজার’, ‘মির্চ মসালা’, ‘অর্থ’-এর মতো ছবিতে নানা ধরনের চরিত্রে দর্শকের সামনে হাজির হন। সেই আশির দশকেই স্মিতা মূলধারার এই সব ছবির জগতে প্রবেশ করেছিলেন। এবং আচমকাই ভেঙে দিয়েছিলেন হিন্দী ছবির বহুকাল ধরে লালন করা মিথ—নায়িকা হতে গেলে ফর্সা হতেই হবে, চেহারায় বুদ্ধি-মেধার স্পষ্ট ছাপ থাকাটা জরুরি নয়। অভিনেত্রী আর তাঁর শরীর- আজ কেন, ভারতীয় সিনেমায় বহু দিনের চর্চিত বিষয়, যা আজও বিনোদন জগতের অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু স্মিতা দেখিয়ে দিতয়ে পেরেছিলেন এ দেশের সনাতন ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শ্যামবর্ণা ও প্রথাগতভাবে সুন্দরী না হয়েও একের পর এক ছবিতে নায়িকারূপেও পর্দা কাঁপানো যায়, কাঁপিয়ে দেওয়া যায় আপামর দেশবাসী পুরুষের হৃদয়ও। ভাগ্যিশ তিনি সিদ্ধান্ত বদল করেছিলেন, নাহলে এতরকম চরিত্রে স্মিতাকে দেখতে পাওয়া থেকে দর্শক বঞ্চিত হতেন।

তা বলে কি স্মিতা সুন্দরী নন? তথাকথিত গ্লামারবিহীন আপাত অগোছালো সাদামাটা চেহারা- অথচ তার মেদবিহীন দীর্ঘ ছিপছিপে তনু, নির্মল নিস্কলুষ সারল্যের হাসি, মেধার ঔজ্জ্বল্যে ঝলমলে স্বাধীনচেতা নারীর ইমেজ। এসব হয়তো ভারতীয় সিনেমার নায়িকা হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু মাত্র ৩১ বছরেই ঝরে যাওয়া এক অভিনেত্রী তাঁর মেধার ঔজ্জ্বল্য আর তথাকথিত গ্লামারবিহীন সৌন্দর্যেই   আশির দশকের যৌবনদৃপ্ত নতুন আইকন হয়ে উঠেছিলেন। অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত আর আত্মপ্রত্যয়ী এক জোড়া চোখই স্মিতা পাতিলের বাহ্যিক সৌন্দর্য্য, বাকী সবটাই মননশীল সৌন্দর্য। যে কারণে মৃত্যুর তিনদশক পরেও তিনি মানুষের মনে অমলিন স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করছেন। স্মিতার অভিনয় নিয়ে তাঁর জীবনীকার মৈথিলী রাও লিখেছেন, “স্মিতা মেথড অভিনেতা ছিলেন না। নিজের অনুভূতি আর সহজাত প্রবণতাকে অনুসরণ করতেন তিনি।” স্মিতা নন, পর্দায় তাঁর চরিত্রই ছাপ রেখে যেত দর্শকদের মনে। এমন অভিনয় কী ভাবে করতেন তিনি? এর উত্তরেও মৈথিলী তাঁর বইতে জানিয়েছেন, পরিচালকের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে ছেড়ে দিতেন স্মিতা। মৈথিলীর কথায়, “হার গ্রেটেস্ট অ্যাসেট ওয়াজ হার ইনটেনসিটি, ইনটেনসিটি বিকামস হার, ইনটেনসিটি ডিফাইনড হার।”
Share.

3 Comments

  1. স্মিতা খুব কম বয়সে মারাঠি ভাষায় দূরদর্শনে সংবাদ পাঠিকার চাকরি পান। কিন্তু সেই চাকরি করার কোনও পরিকল্পনাই তখন তাঁর ছিল না। স্মিতার বোন অনিতার বান্ধবী জ্যোৎস্না দূরদর্শনে চাকরি করতেন। স্মিতা সেদিন তাঁর বোন ও তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে গিয়েছিলেন মুম্বই দূরদর্শনের কাজ কিভাবে হয় দেখতে। আর ঠিক সেদিনই সেখানে সংবাদ পাঠকদের অডিশন হচ্ছিল। জ্যোৎস্নার আগ্রহে স্মিতাও অডিশন দিলেন এবং নির্বাচিত হলেন। কিন্তু স্মিতা তখন কলেজপড়ুয়া। দূরদর্শনের চাকরি করতে গেলে তো প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। অগত্যা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর না করিয়ে তাঁকে দৈনিক পারিশ্রমিকের শর্তে কাজে নিয়োগ করা হয়।

  2. Parnali Banerjee on

    অভিনয় নিয়ে অত্যন্ত সচেতন স্মিতা ‘চক্র’ ছবি করার সময় মুম্বাইয়ের বস্তিতে গিয়েয়েছেন। ‘গলিয়ো কা বাদশা’ ছবির শ্যুটিং এর সময় সহশিল্পী রাজকুমারকে শোয়া অবস্থায় মেক আপ নিতে দেখে স্মিতাও জেদ ধরেছিলেন তাঁকেও ওইভাবে মেক আপ করাতে হবে। যদিও সেই সময় তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন মেকআপ আর্টিস্ট দীপক সাওয়ান্ত। তবে স্মিতার অকাল মৃত্যুতে তিনিই স্মিতাকে ওইভাবে মেক আপ করে দিয়েছিলেন তাঁর কথা রাখার জন্য।

  3. Sabuj Mukhopadhyay on

    স্মিতা পাতিলের ওপর লেখায় এমন শিরোনাম Excellent।

Leave A Reply

Exit mobile version