১৬৫৮ থেকে ১৬৬৪ সাল-দীর্ঘ ছ’বছর ধরে ব্লাঙ্ক ভার্স বা মুক্ত ছন্দে লেখা এবং তারও বছর তিন পরে প্রকাশিত একটি মহাকাব্য আজও বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা সম্পদ। ওই মহাকাব্য রচনার বেশ কয়েক বছর আগেই কবির জীবনে নেমে এসেছিল মহাদুর্ভোগ। তিনি দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করেছিলেন। যদিও ছোটবেলা থেকেই তার দৃষ্টিশক্তি একটু একটু করে ক্ষীণ হতে শুরু করেছিল। চিকিৎসকরা তাঁকে পড়াশোনা ও লেখালিখির কাজ থেকে বিরত হতে বলেছিলেন। কিন্তু তা যে তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই অতি ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েও পড়া ও লেখার কাজ চালিয়ে যান। পরিণতি কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি দৃষ্টি হারিয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডে প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের অবসান ঘটে ফের রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম চার্লসের পুত্র দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে বসেন। রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র সরকারের আমলে ল্যাটিন সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত মহাকবি পদচ্যুত হলেন। সেই সঙ্গে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল তাঁর সমস্ত রচনা। অন্ধত্বের জন্য রাজরোষ থেকে কোনোরকমে মুক্তি পেলেন তিনি। এরপর কবি পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্র্য় নিলেন লন্ডনের অদূরে এক গ্রামের ছোট্ট কুটিরে।

একদিকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলা দৃষ্টিশক্তি তার সঙ্গে চরম অনর- তাঁর নিজের জীবনের হতাশা এবং ব্যর্থতা তুলে ধরে, একই সঙ্গে মানুষের সুপ্ত ক্ষমতাকে নিয়ে আশা ব্যক্ত করে তিনি লিখে চললেন ‘প্যারাডাইস লস্ট’। লেখা মানে বৃদ্ধ, অন্ধ কবি মুখে বলে যেতেন, আর তার হয়ে লিপিবদ্ধ করতেন তার কন্যা দিবোরা। এইভাবে ১৬৬৪ সালে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ সমাপ্ত করলেন জন মিলটন। বাইবেলের কাহিনীকে ভিত্তি করে রচিত মহাকাব্যটি মানুষ জীবনের সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে কিভাবে মহান হতে পারেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ১৬৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েই ইংল্যান্ড জুড়ে বিপুলভাবে সমাদৃত হল মহাকাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ আর আদৃত হলেন মহাকবি নিজে। মহাকালের বিস্তৃত বক্ষপটে চিরকালের জন্য নিজের নাম লিখে দিলেন মিলটন।

মহাকাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ নিয়ে তখন থেকেই ব্যাপক ধর্মীয় সমালোচনা আছে। সেখানে স্রষ্টা এবং শয়তানের ভূমিকা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। যা জন্ম দেয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা সাহিত্য বিতর্কের। পরে ১৬৬৭ সালে দশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল সেটি। প্রকাশের পর পরই দুনিয়াব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৬৭১ সালে প্যারাডাইস লস্ট’র পরবর্তী অংশ প্যারাডাইজ রিগেইনড প্রকাশিত হয়। সেতি নিয়েও কম আলোচনা হয় না। কারণ সেটিও একটি ক্লাসিক। এছাড়া মিলটন ১৬৪০ থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত, ২০ বছর সাংবাদিক হিসেবে একজন কট্টর বিপ্লবীর ভূমিকা পালন করেন। তার শক্তিশালী লেখনী এবং ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তার মতামত সেদিন বিপ্লবের শক্তি যুগিয়েছিল। বিপ্লবের প্রচন্ডতায় শেষমেষ রাজশক্তি হার মানে। জনসমক্ষে রাজা চার্লসের শিরচ্ছেদ করা হয়। ১৬৪৯ সালে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে মিলটন ল্যাটিন সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন।

মিলটন অনেক কবিতা রচনা করেছেন। যৌবনের স্বপ্নীল আবেশে ডুবে দু’চোখ ভরে দেখেছেন লন্ডনের পার্কে নতুন গজিয়ে ওঠা কুঁড়ির মতো তরুণী-তন্বীদের, দেখেছেন বসন্তের প্রগলভতাকে, দেখেছেন নববর্ষের প্রারম্ভে সূর্যালোকে ভরা ফসলকে, দেখেছেন মাটি আর মানুষকে। সুদর্শন মিলটন চাইলে তরুণীদের সাথে ফুর্তি করে, মদের পেয়ালায় রঙিন ক্ষণগুলোকে আরও রঙিনতর করে উপভোগ করতে পারতেন। কিন্ত্য তিনি ব্রতী হন মানবজীবনের গভীরতর সত্য অন্বেষায়। যে কারণে তার রচনার মধ্যেও সস্তা প্রেমের অতিরঞ্জিত উচ্ছ্বাসের কোনো স্থান নেই।

দেশ ভ্রমণে বেড়িয়ে প্যারিস, জেনোয়া, ফ্লোরেন্স ঘুরে বহু খ্যাতনামা কবি ও সাহিত্যিকের সংস্পর্শ পেয়েছেন। তারপর ফ্লোরেন্স থেকে রোমে। ল্যাটিন ভাষা ভালোই জানতেন। রোমে বেশিরভাগ সময় কাটান ভ্যাটিকান লাইব্রেরিতে। রোমের সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি আরও বেশি করে ক্ল্যাসিক সাহিত্যের প্রেমে পড়েন। মিলটন দেখা করেন গ্যালিলিওর সঙ্গে। মিলটনের পরবর্তী জীবনে এই মহতী বিজ্ঞানীর প্রভাব ছিল অপরিসীম। তার বিভিন্ন লেখায় তিনি বারবার গ্যালিলিওর প্রসঙ্গ টেনেছেন। ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এ গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের উপমা টেনেছেন মিলটন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version