“…..জবাকুসুম তেল আমাকে অনেক সুন্দর স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি রোজযখন জবাকুসুম দিয়ে চুল বাঁধি, তখন আমার মা’কে মনে পড়ে, তাঁর একঢাল কালো চুলের কথা। মা বলতেন, আমার দিদিমা নাকি তাঁকে এমনভাবেই জবাকুসুম তেল দিয়ে চুল বেঁধে দিতেন। ভাবতে ভালোলাগে আমার খুকুও যখন বড় হবে, তখন সেও এভাবেই তার চুলের যত্ন নেবে আর ঠিক এমনভাবেই  ভাববে তার মায়ের একঢাল চুলের কথা..”

মনেপড়ে? জবাকুসুমের সেই বিজ্ঞাপন!

শ্রুতিনির্ভর, কিন্তু তার কী কালজয়ী প্রভাব যে আজও মনের মাঝে সেঁধিয়ে আছে কথাগুলো! রেডিও, পরে ফিলিপসের বড় ট্রানজিস্টর, বিবিধ ভারতী চালিয়ে বসে  থাকতাম। গৌরী ঘোষের সিগনেচার কন্ঠে লাবণ্য ঝরে পড়ত। ওই কথাগুলো বারবার শুনেও আশ্  মিটতো না। জবাকুসুম তেল আমার বাবা ব্যবহার করতেন, আর সময় পেলেই মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে আমার দাদুর কাছ থেকে শোনা সি.কে.সেনের অনবদ্য সৃষ্টির আদি গল্প বলতেন- এও এক পরম্পরা।

মা অবশ্য মাথায় মাখতো কেশুত তেল। তেল তো নয়,ঘন সবুজ কেশুত পাতার নির্যাস! গন্ধেই মাদকতা,একটা ঘুম ঘুম ভাব আসত।

বিবিধ ভারতীতেই প্রথম শ্রাবন্তী মজুমদারকে চেনা।৷ “ওয়েসিস্” হেয়ার ফার্টিলাইজার- “মাথার ঘন চুল যখন মরুভূমি হয়ে যায়, ওয়েসিস্ নিয়ে আসে মরূদ্যান, মেঘের  ছায়ায়  ছায়ায়….”। একটা হেয়ার টনিককে চূড়ান্ত জনপ্রিয় করে তুললো ওই গান। প্রতি রবিবার ওয়েসিসের অনুষ্ঠান হত।

ছিল ক্যালকাটা কেমিক্যালসের “তুহিনা”, সুন্দর ছিমছাম ক্ষীণকটি তন্বীর আধারে, ছিল “চন্দনগন্ধনন্দিত স্নিগ্ধ অঙ্গরাগ বসন্ত মালতী”। সুভাষিত বিজ্ঞাপনে এতটুকু  অত্যুক্তি ছিলনা। অমন সুবাস আর কোনো অঙ্গরাগে পাইনি, সত্যি। গ্রীষ্মের দুপুরস্নানে মলয়চন্দন সাবান, আহা, কি ঝরঝরে অনুভূতি! একটা বাক্সে তিনটে সাবান পাওয়া যেত। সারাদিন চন্দনের সৌরভ ঘিরে থাকতো যেন। খোসমেজাজে গেয়ে উঠতাম- আমরা মলয় বাতাসে ভেসে যাব শুধু কুসুমের মধু করিব পান…..

রুমালের কোনে একফোঁটা কান্তা সেন্ট, তবেই বাঙালির বিয়েবাড়ির সাজ সম্পূর্ণ। মনে পড়ে “অগুরু” ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল….

বাঙালি  বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো  একে একে বিলুপ্ত, মুষ্টিমেয় কিছু টিঁকে আছে জীর্ণ দশায়।

ব্যতিক্রম আছে বৈকি! জি ডি ফার্মাসিউটিক্যালসের  বোরোলীন- বঙ্গজীবনের অঙ্গ। এই অভিধা ঋতুপর্ণ ঘোষের মস্তিষ্কপ্রসূত। রবিবারের দুপুরে “বোরোলীনের  সংসার” শুনতে শুনতে মাংস ভাত খাওয়া মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের পরিচিত ছক হয়ে উঠেছিলো। বোরোলীনের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়েছে শ্রাবন্তীর নাম, তাঁর জিঙ্গলের  অনুষঙ্গে- “সুরভিত এ্যান্টিসেপ্টিক ক্রীম বোরোলীন….ত্বক যদি কেটে যায়, ফেটে যায়, খসখসে যদি হয়, রোদ্দুরে ঝলসায়….সারা গায়ে মেখে নিন…..”।

এই বোরোলীন আজও স্বমহিমায় বর্তমান। যতই  গায়ে মাখা,মুখে মাখার ক্রীম আসুক না কেন, বোরোলীনের বারোমাস্যা প্রতি ঘরে ঘরে…..।

রেডিও শোনার দিন, বিবিধ ভারতী উপভোগ করার সময়, বহুজাতিকের ভিড়ে বাঙালি প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই  কোথায়  হারিয়ে গেছে!!

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version