একবছর হয়ে গেছে তিনি নেই।বাংলা গান বাঙালির সঙ্গে তিনি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়েছিলেন বহুকাল আগেই। সে সম্পর্ক আটুট রেখেছেন। সে সময়ে বোম্বাইতে বাঙালি চিত্র ও সঙ্গীত পরিচালকদের আধিপত্য ছিল ঈর্ষন্বীয়। শচীন দেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী, হেমন্তকুমার থেকে রাহুলদেব, বাপ্পি লাহিড়ী সকলের সাথেই হৃদ‍্যতা রেখেছেন, কাজ করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাস নিয়ে ১৯৪৫ সালে হিন্দি ছবি তৈরির পরিকল্পনা করে মুম্বাইয়ের ফিল্মিস্তান। পরিচালক হেমেন গুপ্ত, আর সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে কয়েকদিন রিহার্সালও দিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। কিন্তু রেকর্ডিং-এর সময় বাধ সাধলেন পরিচালক। একের পর এক টেক কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিল না হেমেন গুপ্তর। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতাকে দিয়েই গাওয়াবেন। হেমেন গুপ্ত ধৈর্যহারিয়ে রেগে উঠছেন, লতা নিরুত্তাপ ভাবে পরপর ২১টি টেক দিয়ে গেলেন। পারিশ্রমিক নিয়ে কোনোরকম কথা না বলে, শুধুমাত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্যই গান গাইতে রাজি হয়েছিলেন লতা।

গানের জগত থেকে এই সম্পর্ক এসে পৌঁছেছিল ঘরের অন্দরমহলেও। হেমন্ত তখন এক বন্ধুর বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই তাঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয় লতার। হেমন্ত-বেলা দম্পতির দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময়ও তাঁরা মুম্বাইতেই ছিলেন। হেমন্ত তাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একদিন বেলা মুখোপাধ্যায়ের কাছে হাজির হলেন লতা। বললেন, গর্ভবতী মহিলাদের পছন্দের খাবার খাওয়ানোর রীতি বাঙালিদের মতোই মারাঠিদের মধ্যেও আছে। তিনি সেদিন গর্ভবতী বেলাকে তাঁর ‘সাধ’ খাইয়েছিলেন। আবার হেমন্তবাবুর পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে এক ডাকে কলকাতায় এসে গানের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

বাংলা গানের জগতেও লতা মঙ্গেশকরের আত্মপ্রকাশ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। ১৯৫২ সালে প্রথমবার কলকাতা এসেছিলেন লতা। এসে উঠেছিলেন হেমন্তর বাড়িতেই। ৪ বছর পর আবার ফিরলেন কলকাতা। তবে এবার একেবারে গানের রেকর্ডিং-এর জন্যই। বাঙালি শ্রোতাদের মন মাতিয়ে দিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা গাইলেন ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’।এছাড়া ‘মধু গন্ধে ভরা’, ‘তোমার হল শুরু’ এই দুটি রবীন্দ্রনাথের গান করেন দ্বৈত কন্ঠে।

এরপর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ গানটি তাকে অসম্ভব খ‍্যাতি এনে দেয়। হেমন্তবাবুর সুরে করেন ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। সলিল চৌধুরী একগুচ্ছ ভাল গান উপহার দেন তাকে এবং সেই সঙ্গে আমাদেরও। ধীরে এই মারাঠি কন‍্যা বাঙালির ঘরের মেয়ে হয়ে ওঠেন। শুরু হয় সন্ধ‍্যা ও লতার অনুরাগীর মধ‍্যে কে ভালো শিল্পী সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব।

সেই সময়ে পুজোর গান বলতে লতাজির গান আবশ‍্যিক ছিল। সম্ভবত তার প্রথম পুজোর গান ছিল, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’। পুলক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের লেখা সুর ভূপেন হাজারিকা। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পুজোর গান ছিল, ‘না যেও না’ আর ‘সাত ভাই চম্পা’। সলিল চৌধুরীর গান দুটিই।

সঙ্গীত জীবনে ৩০টির বেশি ভাষায় গান গেয়েছেন লতা। তবে হিন্দি এবং মারাঠি ভাষার পর সবচেয়ে বেশি গান গেয়েছেন বাংলাতেই। লতার কণ্ঠে বাংলা গানের সংখ্যা ১৮৫টি। প্রথমদিকে অবশ্য বাংলা ভাষা জানতেন না তিনি। কিন্তু বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। বাংলা শেখার জন্য বাসু ভট্টাচার্যের কাছে রীতিমতো ক্লাস করেছেন। আর প্রতিটা বাংলা গানের উচ্চারণে আর গায়কিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালিই।

১৯৫৬ সালেই ভূপেন হাজারিকার সুরে গাইলেন ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’। ’৫০-এর দশকেই সলিল চৌধুরীর সুরে গাইলেন ‘যা রে উড়ে যা রে পাখি’, ‘না যেও না’, ‘ওগো আর কিছু তো নয়’। প্রতিটা গান পরে হিন্দিতেও গাওয়া হয়েছিল। হেমন্তর সুরে ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’; সুধীন দাশগুপ্তর সুরে গেয়েছেন ‘চঞ্চল মন আনমনা হয়’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ’-এর মতো বহু গান।আধুনিক ছাড়াও অসংখ্য বাংলা চলচ্চিত্র লতাজির কোকিল কন্ঠের ছোঁয়া পেয়েছে। বাংলা গান যতদিন থাকবে লতা মঙ্গেশকর এর নামও উচ্চারিত হবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version