দ্বিতীয় পর্ব

বাড়িতে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। জিনিসপত্র বলতে কয়েকটা জামাপ্যান্ট, পায়জামা, গামছা আর একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ‘কোডাক ৩৫’ ক্যামেরা। রাতে দাদাকে আমতাআমতা করে একটু মিথ্যা মিশিয়ে জানালাম, কলকাতার এক বন্ধুর সঙ্গে রবিবার আন্দামান বেড়াতে যাবো। সব শুনে কিছু না বলে গম্ভীর মুখে উঠে গেল দাদা।। আর এক দাদা কিছুটা দাঁত খিঁচালো বটে তবে শ’দেড়েক টাকাও দিল। ও দাদা ছিল ও রকমই। খুব ভালো মনের খুব মেধাবী ছাত্র , তবে সেসময় আবেগ তাড়িত হয়ে এক অন্যধারার রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়। বাড়ির বুঝদার অন্যেরা তার আবেগ বোঝার চেষ্টা একটুও করেনি। ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি জীবনের মূল স্রোতে। ও দাদা আমাদের অনেক দিন আগেই ছেড়ে গেছে। মর্মান্তিক ভাবে নিজেই সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে।

তখন বাবা নেই। অন্য দু’দাদা আর সবচেয়ে ভালোবাসার এক দিদি থাকতো বাড়ির বাইরে, সবাই ছিল স্কুল শিক্ষক। ছোট বেলায় আমি নাকি ছিলাম খুব একগুঁয়ে আর ডানপিটে। তখন থেকেই বাড়ির সবাই ধরে নিয়েছিল  ভবিষ্যৎ আমার জন্য মোটেই উজ্জ্বল নয়। সে ভাবনা যে অমূলক ছিল না এখন বেশ বোঝা যায়। মা সারারাত না ঘুমিয়ে কাঁদলো আর বারেবারে বোঝালো একা একা না যাওয়ার জন্য। কিন্তু তখন যেন মাকেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিতে ভালো লাগতো। যৌবন আর বয়ঃসন্ধির সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিতাম মায়ের উপর। আসলে মা ছাড়া রাগ দেখানোর আর কেউ ছিল না। আমার মা, যমুনাবালা পাল। মায়ের কথা লিখেছি আগে এই ফেসবুকের পাতায়, কেউ কেউ হয়তো পড়েও থাকবেন। যাকগে ওসব কথা। স্মৃতির সুতো ধরে টান দিলে হয়তো চলে যাবো প্রসঙ্গান্তরে, তার চেয়ে যে গল্প ফেঁদে ছিলাম সেখানেই ফিরে আসা যাক।

জাহাজ  ছাড়বে রবিবার, হাতে মাত্র একটি দিন। শনিবার বেরিয়ে পড়লাম আন্দামানের খবর সংগ্রহ করতে। কিন্তু ডকের কাছে, ‘রবীন্দ্র বাংলা বিদ্যালয়’ বলে একটা বাংলা মিডিয়াম স্কুল আর একটি ইউথ হোস্টেল আছে এছাড়া অন্য কোন খবর সংগ্রহ করতে পারিনি।

একরাশ শঙ্কাকে সঙ্গে নিয়ে রবিবার বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল। খিদিরপুরের তিন নম্বর ডক পর্যন্ত আমার সঙ্গী হলো স্কুলের সহপাঠী দুই বন্ধু মলয় ও অশোক। তখনও ভাবছি মেডিক্যাল টেস্টে আটকে গেলে ভালো হয়। কিন্তু কোথাও আটকালাম না। এক সময় মলয় আর অশোককে ছেড়ে, কান্না চেপে দুরুদুরু বুকে  উঠে গেলাম জাহাজের লম্বা উঁচু সিড়ি বেয়ে। ভাবছিলাম আরকি ফিরতে পারবো এখানে, আরকি দেখা হবে যমুনা বালার সঙ্গে?কান্না ভেজা চোখে তখন শুধু যমুনা বালার ছবি।

পা যেন আর চলে না, তবুও অনেক সিঁড়ি ভেঙে একসময় জাহাজের খোলের মধ্যে আমার নির্দিষ্ট সিট বা শোয়ার জায়গায়। বুকের ভেতর তখন কে যেন দুরমুশ পিটিয়ে চলছে, নিজেই শুনতে পাচ্ছি একটানা ধুপধাপ শব্দ। ভাগ্যিস বুকের শব্দ বাইরে বের হয়না। কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছে, মা গো বলে। একটু ধাতস্থ হয়ে এক চুমুক জল খেলাম। তখনও প্লাস্টিকের বোতলে জলের আমদানি হয়নি, খাওয়ার জল সঙ্গেই রাখতে হতো। সঙ্গে ছিল বাবার আমালের একটা ওয়াটার বটল।সিলভারের একটা চৌকো বাক্স,বাইরেটা একরকম রেক্সিন দিয়ে মোড়া।

জাহাজের বিরাট খোলের মধ্যে ব্যাঙ্ক ক্লাস। রেলের স্লিপারের চেয়ে সামান্য বড় সারি সারি দু’থাকের এক একটা পাটাতন। সেখানেই  শোয়া বসা, সেখানেই মালপত্র রাখা। বাড়তি জিনিসপত্র  রাখার জন্য রয়েছে একটা লকারের মতো জায়গা। সেটা বোধহয় ততটা নিরাপদ নয়। আমার অবশ্য লটবহর বলতে একটা ব্যাগ আর একটা সেকেন্ড হ্যান্ড কোডাক ক্যামেরা। আমার সামনের সিট দুটিতে অনেক কাচ্চাবাচ্চা হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে এক সাউথ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি। নিচে ধুতি পাঞ্জাবি পারা এক সৌম দর্শন বাঙালি ভদ্রলোক।

নিজের জায়গায় শুকনো মুখে বসে ছিলাম মন খারাপ করে। একটু দূরে আমার চেয়ে সামান্য বড়  কয়েকজন বেশ হৈ-হুল্লোড় করছে দেখলাম। তৃষ্ণার্তের মতো সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি কারণে জানিনা দু’জন হঠাৎ এগিয়ে এলেন,  জানতে চাইলেন আন্দামানে আমি বেড়াতে কিনা? সঙ্গেই বা রয়েছে কারা? আমি একা এবং বেড়াতেই যাচ্ছি শুনে তাঁরা বেশ অবাক হলেন। ওঁরা ৮জন। এসেছেন কল্যাণী থেকে, সবাই বিএডের ছাত্র। উপরের কেবিনে রয়েছেন কলেজের এক ম্যাডাম। আজ এতদিন বাদে একজন ছাড়া কারও নাম মনে নেই। তাও পদবীটা স্মরণে আনতে পারছি না। মনে আছে ভদ্রলোকের নাম ‘কমল’, একটি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। এও মনে রয়েছে বাড়ি কৃষ্ণনগরে এবং ‘এসইউসিআই’-এর রাজনীতি তে বিশ্বাসী। অসম্ভব স্নেহ প্রবণ ভদ্র মানুষ। মুহূর্তে আমি হয়ে গেলাম তাঁদের অসমবয়সী বন্ধু। ওঁরাও আমাকে আপন করে নিলেন। সারাটা সময় সবাই আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছিলেন। কমল দা এবং কল্যাণীর বিএড কলেজের অন্য ছাত্রদের সঙ্গে উঠে গেলাম জাহাজের ডেকে।

(চলবে) 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version