দ্বিতীয় পর্ব

একসময় শিকাগোর অপরাধ দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতেন বিগ জিম কলোসিমো। শিকাগো শহরের প্রায় সব পতিতালয়, জুয়ার ঠেক চলতো তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে। কিন্তু কলোসিমোর অপরাধ দুনিয়ায় কোনো সুরিখানা ছিল না। সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনী অনুযায়ী তখন অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় উৎপাদন, বিতরণ এবং বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।বিগ জিম হয়তো বাড়তি ঝামেলা এড়িয়েই চলতেন। কিন্তু টরিও ভাবতেন,নিষিদ্ধ জিনিস বাজারজাত করলে স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ করা যায়।তাই নিষিদ্ধ অ্যালকোহল ব্যবসার কথা বারেবারেই ভাবতেন টরিও। তিনি বহুবার কলোসিমোকে সুরিখানা খোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কলোসিমো সে কথা কখনো কানে তোলেন নি। এরপর একদিন হটাৎ আততায়ীর গুলিতে কলোসিমো নিহত হন। ওই বছরইআল কাপোন শিকাগোর মাটিতে পা রেখেছিলেন। যদিও কলোসিমো হত্যার দায়ে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তখন অনেকের মনেই ধারণা হয়েছিল যে, কলোসিমো হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছেন টরিও-কাপোন জুটি। কলোসিমোর মৃত্যুর পর শিকাগোর অপরাধ দুনিয়ায় টরিও-কাপোন জুটির উত্থান ঘটে।

অ্যালকোহল ব্যবসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকা স্বত্বেও আল কাপোন শিকাগোতে মদ চোরাচালানের ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে তা বেশ জমে উঠেছিল। আসলে আল কাপোন তাঁর প্রখর বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে পেরেছিলেন। আর এই দক্ষতার জন্য তিনি খুব তাড়াতাড়ি টরিওর প্রধান সহচর বনে যান।নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো আল কাপোনের পকেট ধীরে ধীরে ডলার পাউন্ডে ভরে ওঠে। আর আল কাপোন সেই ডলার পাউন্ড ওড়াতে থাকেন মদ্যপ অবস্থায় রাত কাটিয়ে।

মদ চোরাচালানের ব্যবসায় কাপোন যতটা ধারালো বুদ্ধি ও সতর্ক ছিলেন, তার বাইরে ততটাই অসতর্ক ছিলেন তিনি। একদিন সেই অসতর্ক আল কাপোন মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে এক ট্যাক্সিকে ধাক্কা মেরেদূর্ঘটনা ঘটিয়ে এক কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গেলেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কাপোনের জেল হয়। এতদিন তাঁর মাফিয়া জীবনেযত অপরাধ বা অপকর্ম করেছেন, তার জন্য থানা পুলিশ মিলে কোনও শাস্তি ধার্য হয়নি, এবারই তাকে প্রথম জেলে যেতে হল। যদিও তাঁর জেল খাটার মেয়াদ ছিল মাত্র একদিন। জেলে ঢোকার পরপ্রের দিনই টরিও তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করেআল কাপোনকে জেল থেকে বেরকরে এনেছিলেন। এর জন্য টরিওকে প্রভাব খাটিয়ে স্বয়ং শিকাগোর মেয়রের কাছে পৌঁছাতে হয়েছিল। তাঁর হস্তক্ষেপ ছাড়া আল কাপোনের মুক্তি অত সহজে সম্ভব হতনা।

ট্যাক্সি দুর্ঘটনায় আল কাপোন নিজের জীবনে বেশ বেশ বড়সড় ধাক্কা খান। ওই ঘটনার পর থেকে তার চালচলনে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তিনি বেশ সতর্ক হয়ে ওঠেন। প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে ফেলতে শুরু করেন। শিকাগো আসার আগেই আল কাপোন বিয়ে করেছিলেন। শিকাগোর মাফিয়া জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর তিনি তাঁর স্ত্রী সন্তানদের শিকাগো নিয়ে আসেন। মাফিয়া জীবনের মাঝেও আল কাপোন নিজের পারিবারিক জীবনের প্রতি কখনো অবহেলা করেননি। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু ১৯২৩ সালের শিকাগো শহরের মেয়র নির্বাচনে টরিও সমর্থিত মেয়র হেরে গেলে নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়েই ধরপাকড় অভিযান শুরু করেন। আল কাপোন এবং টরিও ভয় পেয়ে যান, শিকাগো যে তাদের পক্ষে নিরাপদ নয় বুঝতে পারে তাঁরা দুজনেই শিকাগো থেকে চম্পট লাগান।

আল কাপোন এবং টরিও পালিয়ে গিয়ে সিসারো নামক একটি মফস্বলে আশ্রয় নেন। কিছিদিনের মধ্যে এখানেও তাঁরা নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু কথায় বলে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সিসারোতেও মেয়র নির্বাচন এসে পরে। টরিও-কাপোন এখানকার মেয়র নির্বাচনে বেশ সতর্ক হয়ে ওঠেন। যাতে কোনোভাবেই তাঁদের সমর্থনের বাইরে কেউ নির্বাচিত হতে না পারেন, তার জন্য ছক কষতে থাকেন। মেয়র নির্বাচনের দিন টরিও-কাপোন বেশ কয়েকটি গুপ্তহত্যা করেন। কেবল তাই নয়, টরিও-কাপোন মেয়র নির্বাচনের দিন বিরুদ্ধ পক্ষের অনেক ভোটারকে উন্মুক্ত রাজপথে গুলি করে হত্যা করেছে, এমন অভিযোগও ওঠে। সিসারোতে জনরোষ সামাল দিতে শিকাগো থেকে বিশেষ পুলিশ স্কোয়াড পাঠানো হয়। পুলিশ স্কোয়াডসিসারোতে পৌঁছানো মাত্র টরিও-কাপোন গ্যাংয়ের সঙ্গে পুলিশের বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়, পুলিশের গুলিতে আল কাপোনের ভাই ফ্রাঙ্ক নিহত হন। এই ভাবে শিকাগো থেকে সিসারোতে বিশৃঙ্খলা এবং ত্রাস ছড়িয়ে দেয় টরিও-কাপোন মাফিয়া গ্যাং।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version