ঠিক যে মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলার রাজ্য ও রাজনীতির পালাবাদলের ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার জমি আন্দোলনের সেই ধাত্রীভূমিতে পা রাখলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরে জঙ্গল মহলের পর তাঁর নজরে হুগলি জেলা। যদিও বৃহস্পতিবার ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়ায় শীতলা মন্দিরের পুজোর অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে জানান, কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্মসূচি নয়, সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া গ্রামে সন্তোষী মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে যাবেন তিনি। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে আসল কথা পঞ্চায়েত ভোট। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর অনুযায়ী যার সময়সুচী আগামী বছর মে মাসে।

যদিও ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটেজমি আন্দোলনের এই মাটিতে তৃণমূলযে ফল করেছিল তাতে এবারও চিন্তার কারণ নেই। গ্রাম পঞ্চায়েতের ২০৭ আসনের মধ্যে তৃণমূল একাই পেয়েছিল ২০২টি।পঞ্চায়েত সমিতির ১৮টি আসনের মধ্যেও সবকটি পেয়েছিল এমনকি জেলা পরিষদের ৫০টি আসনেরও সবকটি পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর একুশের বিধানসভা ভোটেও তৃণমূলএই জেলায় ভাল ফল করেছিল। যদিও আরামবাগ লোকসভার অন্তর্ভুক্ত চারটি বিধানসভায় তারা হেরেছিল। এমনকি বাংলার শাসক দল পুর ভোটেও ভালো ফল করেছে। তবে এই জেলার গ্রামাঞ্চলে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ মমতার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আরামবাগ, খানাকুল, পুরশুড়া ও গোঘাট।

প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৩৫ আসনে জিতে বামফ্রন্ট বাংলায় শেষবার ক্ষমতায় আসে। তখনআওএকবার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।তখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন, সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানা তৈরি হবে। সেই কারখানার জমি অধিগ্রহণকে ঘিরেই শুরু হয় জমি আন্দোলন। পরের ইতিহাসটা সকলেরই জানা। এই জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টানা ২৬ দিন অনশনে বসেছিলেন। আন্দোলনের জেরে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে টাটারা। আর তারই জেরেই পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

ওইবছর বাম সরকার টাটার ন্যানো গাড়ি কারখানা স্থাপনের জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তনেয়। পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না পাওয়া এবংকৃষি জমি এবং জীবন-জীবিকা হারানোর ভয়ে প্রায় ৬,০০০ পরিবার পিছিয়ে যায়।তখনকার বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে অনিচ্ছুক জমিদাতাদের সমর্থনের বীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও বেচারাম মান্নাকে নিয়ে ভূমিরক্ষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, দলের নেতাদের নিয়ে ধরনায় বসেন। একসময়ে সেখান থেকে সরাতে বাধ্য হয় টাটা-র ন্যানো কারখানা।

বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের পর কৃষকদের ৯৯৭ একর জমি থেকে প্রায় ৪০০ একর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি বিল পাস হয়। ২০১৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকজন কৃষককে জমি ফিরিয়ে দেন। প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে যে  সবাই জমি ফেরত পেয়েছে কিনা, তবে সেখানে বিকল্প কোনও শিল্প আজও গড়ে ওঠেনি। কারখানা এলাকার পাশের হাইওয়ে দিয়ে যেতে গেলে আজও সেই ন্যানো কারখানার পরিত্যক্ত কাঠামো দেখতে পাওয়া যায়।

তবে সিঙ্গুরের গ্রামবাসীদের একাংশ তাঁদের জমি ফেরত পেয়ে সেই জমিতে আলু এবং ধানের চাষ করছেন। কারণ তাঁরা কৃষিকাজ ছাড়া আরকিছু পারেন না। তাই কারখানার বদলে জমি ফিরে পেয়েছেন বলে তাঁরা খুশি। তবে এই সংখ্যাটা বেশি নয়। তাই সিঙ্গুরে কান পাতলে এখন শোনা যায় শিল্প নয় উন্নয়ন। কিন্তু কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও সিঙ্গুরের নতুন প্রজন্ম কৃষিকাজ করতে চাইছেন না। তাঁরা কলকাতা বা দিল্লির মতো বড় শহরে গিয়ে কাজ করতে চান। কিন্তু, সকলের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা চান সিঙ্গুরে শিল্প হোক।

৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এলেও সিঙ্গুরে শিল্পের দাবিতে ইতিমধ্যেই সুর চড়ায় বিজেপি ও সিপিএম। সেই সিঙ্গুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ঘোষণা করেন। মমতা বলেন,’সিঙ্গুরে অ্যাগ্রো ইন্ডাসস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করছি। সেখানকার ফসল সুজলা, সুফলা। ১১ একর জমির উপরে পার্ক তৈরি করছে পশ্চিমবঙ্গ ক্ষুদ্রশিল্প উন্নয়ন নিগম। সিঙ্গুর রেলস্টেশনের কাছে জমি ঘেরা শুরু হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছুক শিল্পপতিদের ১০ থেকে ৩০ কাটার প্লট দেওয়া হবে। বড় প্লটও থাকছে। শিল্পপতিদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিকল্পনাও করতে পারি’। কিন্তু হুগলি লোকসভা আসনে জেতে বিজেপি। হুগলির প্রশাসনিক পর্যালোচনা বৈঠকের ফাঁকে জেলার নেতা ও জন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী দলের প্রায় হাফ ডজন নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের ভর্ৎসনা করেন। জেলার দুই মন্ত্রী ও বিধায়ককে সতর্ক করে দেন।  তাঁদের কাজকর্মে অসন্তোষ প্রকাশ করে মমতা বলেন, ‘‘আপনারা এমন লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন যাদের ভাবমূর্তি একেবারে ভাল নয়।’’

এদিন সিঙ্গুর থেকে কামারকুন্ডুর রেল ওভারব্রিজের ভারচুয়াল উদ্বোধন হয়। মমতা জানান সিঙ্গুরে কৃষি এবং শিল্প একইসঙ্গে এগোচ্ছে, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি, কোচ ফ্যাক্টরি সহ আরও অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে। উত্তরপাড়ায় হিন্দুস্তান মোটরস-এর কারখানার কথাও বলেন তিনি। প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী ২০০৮ থেকে শিল্প এবং অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রির কথা বলছেন। কিন্তু তাঁকে এখনও যদি সেই কথাই বলতে হয় তাহলে বুঝতে হবে তিনি এক যুগ ধরে যা বলছেন তা এখনও কার্যকর হয়নি। শিল্প এবং কৃষি পাশাপাশি চলবে একথা তো তিনি সরকারে আসার আগে থেকেই বলে চলেছেন, কারণ সেটাই ওনার দাবি ছিল। উনি সরকারে এসেছেন প্রায় এক যুগ, তার মানে এটাই বুঝতে হবে যে তিনি নিজের দাবি নিজেই পূরণ করতে পারেন নি।
Share.

3 Comments

  1. ram jiban vattashali on

    শুধু উদ্বোধন আর উদ্বোধনই হচ্ছে বিগত এক দশক ধরে। আগের তিন দশক যেমন সব গায়েব হয়েছিল। যা পড়েছিল এখন তা চুরি আর চুরিতে লোপাট। যে সিঙ্গুর দিল ক্ষমতা সেই সিঙ্গুর থেকে টাটারা ভাগলো ঠিকই কিন্তু বিঘে কয়েক জমিতে আলু কুমড়ো ছাড়া আর কিছু কি হয়না। এর নাম যদি কৃষি হয় অথবা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি তাহলে আর কিছু বলার নেই…

  2. chaitali chattopaddhaya on

    সিঙ্গুরে কৃষি-শিল্প হোক আর না হোক বাজেমেলিয়া গ্রামে সন্তোষী মায়ের মন্দির তো হয়েছে। গ্রামের কৃষিহারা মানুষ জমির ফসল না পাক সন্তোষী মায়ের দেখা তো পাচ্ছেন।

  3. Amarnath Mondal on

    সব পরিকল্পনাই সুন্দর কাগজে। বাস্তবে কার্যকর হলে, তবেই তার সার্থকতা।

Leave A Reply

Exit mobile version