চতুর্থ পর্ব

“বাড়িতে শেতলা পুজো৷ চারদিন আসতে পারবোনি৷” ‘কাজের দিদি’র এই  ছোট্ট ঘোষণায় সংসারের সুখ তছনছ৷ এক ঘোষণায় সবার মেজাজ টঙে৷ ‘কাজের দিদি’র এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গৃহকর্ত্রীর দফতর৷ দফতর বললাম এই কারণে, এখনকার বেশিরভাগ মহিলা বিভিন্ন কাজে বাইরে বেরোলেও, রান্নাঘরে তাঁদের মৌরসিপাট্টা ঠিক আগের মতোই৷ ওই দফতরটি তাঁরা কোনওভাবেই হাতছাড়া করতে চান না৷ তার প্রধানত দু’টো কারণ৷ এক, ঘরে এই দফতরটির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন জড়িত৷ দুই, বাইরে কাজের সূত্রে অনিবার্যভাবে পাওয়া বসের মুখঝামটা সহ্য করে আসার পর এই একটি জায়গাতেই তো ‘কাজের দিদি’র উপর বসিজম ফলানো যায়৷

অতএব সেই কাজের দিদি ছুটি নিলে পরিবারের বাকি সদস্যরাও নিশ্চিত হয়ে যান, হোম মিনিস্ট্রি থেকে অনিবার্যভাবে তিনটি বিজ্ঞপ্তি জারি হবে৷ এক বাড়িতে রান্না হবে না, ইমিডিয়েট হোম ডেলিভারিতে ফোন করা হবে৷ দুই, সকালে চা, বিকেলে চাউমিনের আদিখ্যেতা আপাতত স্হগিত৷ আর তিন হল, পারলে একই জামাকাপড় পরে কাজে যাও, কোনওভাবেই জামাকাপড় নামানো যাবে না৷ এমনও পরিবার দেখেছি, ‘কাজের দিদি’ টানা ছুটি নিলে কাছাকাছি কোনও আত্মীয়র বাড়িতে ক’টা দিন কাটিয়ে আসার ফন্দিফিকির খোঁজেন৷ যাঁদের এক ঘোষণাতেই পরিবারের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই ‘কাজের দিদি’রা এখনও দিদি হয়ে উঠতে পারেননি কোনও পরিবারে৷

উল্টোভাবে বললে আমরা শিক্ষা-স্বাস্হ্য-কর্মসংস্হানে অনেক এগোলেও, পরিচারিকাকে দিদি বলে ডাকার মতো মন বড় করতে পারিনি৷ সমাজও ‘কাজের দিদি’দের শ্রমের কোনও মর্যাদা দিতে পারেনি৷ কোনও পরিবারে কন্যাসন্তান যদি লেখাপড়ায় মনোযোগী না হয়, সৃজনশীল কাজে অনীহা দেখায় তাহলে তাকে ভর্ৎসনা করে আমরাই তো বলি, “যা ঝি-গিরি করে খা৷” আবার কোনও ঝগড়া যখন চরমে পৌঁছয়, নিজেকে ভাল প্রমাণিত করতে ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আমরাই তো বলি, “ঝি-চাকরের মতো চেল্লাচ্ছিল কেন?” পোশাক-আশাক ময়লা হলে আমরাই তো বলি, “ঝি-চাকরের মতো চেহারা করেছে দেখো৷”

গৃহকর্মে নিযুক্ত মেয়েদের সম্পর্কে আমাদের এতটাই নিম্নদৃষ্টিভঙ্গী যে আমরা প্রায়শই বলি, “ওরা ঝি-চাকর শ্রেণির লোক, ওদের সঙ্গে এত কথা কীসের?” যদিও একথা ঠিক ‘ঝি’ শব্দটি পাল্টে এখন ‘কাজের লোক’ হয়েছে৷ সেখানেই একটি প্রশ্ন৷ আমরা যাঁরা একটি চাকরি জোগাড় করেই শ্লাঘাবোধ করি, কলার উঁচিয়ে গাড়িতে উঠি, তারা কি কাজের লোক নই? আমরাও কি শ্রম বিক্রি করছি না মাস শেষে কিছু টাকা পাওয়ার আশায়? তবে ক্ষেত্র দু’টি আলাদা একটা জায়গায়৷ অনেকের মতো ‘কাজের দিদি’রা সংগঠিত নন৷ তাই বোনাসের দাবিতে, ইনক্রিমেণ্টের দাবিতে তাঁরা কাজ বন্ধ রাখতে পারেন না৷ আবার সভ্য ‘কাজের লোক’দের মতো উচ্চাকাঙ্খায় চেয়ার দখলের জন্য কাঁকড়াও হতে পারেন না৷

তবে এই ‘কাজের দিদি’দের কথা ভেবে শ্রীমতী এলা ভাটের নেতৃত্বে যে ‘শ্রমশক্তি’ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে, অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা প্রধানত সবচেয়ে কঠিন, বৈচিত্র্যহীন অধিক সময় সাপেক্ষ এবং বেশি পরিশ্রমের কাজ পায়৷ বাস্তবে কর্মরত (অন্যের বাড়িতে কাজ করা) বিশাল এই শ্রমিকবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ঠিক কত তার কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই৷ এঁদের উপার্জন যেহেতু অনিয়মিত, তাই জাতীয় আয়ে এঁদের অবদানের কোনও উল্লেখ থাকে না৷ জাতীয় কমিশনের রিপোর্টেও এই ‘কাজের দিদি’দের সম্পর্কে কোনও তথ্য সেভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি৷ অথচ এই পেশা একেবারেই নতুন নয়৷ প্রাচীনকাল থেকেই পরের সংসারে শান্তি বজায় রাখতে ওঁরা কাজ করতেন, এখনও করেন৷ শুধু বদলেছে ধরনটা৷ আগে পরিচারক, ভৃত্য বা চাকর হিসাবে পুরুষদেরই নিয়োগ করা হত৷ ধনী বা জমিদার বাড়িতে পুরাতন ভৃত্য নিয়ে অনেক কাহিনিও আছে৷ কিন্ত্ত তিন-চারের দশক থেকে গৃহকর্মে পুরুষদের সংখ্যা দ্রূতহারে কমতে থাকে৷ পেশাটি সম্পূর্ণভাবে মহিলাদের দখলে চলে যায়৷ সেই থেকেই পরিবারের শান্তি ‘কাজের দিদি’দের হাতে সঁপে দিয়ে আমরা  নিশ্চিন্ত থাকি৷ শুধু ভুলে যাই দিদিদের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে নিজেদের সম্মানিত করতে৷

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version