মৌণ অতীতকে তিনি তাঁর জাদুলেখনীর ছোঁয়ায় মুখর করে তুলেছিলেন তাঁর ইতিহাস ভিত্তিক আখ্যান ও গল্পগুলিতে। আবার একই সঙ্গে সেই সময়ে কিছুটা অন্ত্যজ হয়ে থাকা গোয়েন্দা কাহিনীর শাখাটিকেও করেছিলেন সাহিত্য রসে অভিসিঞ্চিত। ‘কালের মন্দিরা’, ‘গৌড়মল্লার’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ প্রভৃতি ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস এবং ‘চুয়াচন্দন’, ‘শঙ্খকঙ্কণ’ এর মতো ইতিহাস ভিত্তিক গল্পগুলিতে তিনি সুনিপুন ভাবে এঁকেছিলেন বাংলা তথা ভারতের এক গৌরবময় অতীতের ছবি। তাঁর এই ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস ও গল্পগুলিতে নিটোল কাহিনী বিন্যাসের সঙ্গে মিশেছিল ভাষার অনন্য প্রসাদগুণ। অনবদ্য ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ পড়ে মুগ্ধ ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার একটি চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন, “আপনি বিজয়নগরের অতীত ঐশ্বর্য স্মৃতি একটি মনোরম কাহিনীর মধ্য দিয়া ফুটাইয়া উঠাইয়াছেন- এ জন্য আমরা অর্থাৎ ঐতিহাসিকেরা খুবই কৃতজ্ঞ- কারণ লোকে ইতিহাস পড়ে না- কিন্তু আপনার বই পড়িবে।” আর প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন- আপনার গল্প পড়তে পড়তে বঙ্কিমবাবুকে মনে এনে দেয়- তিনি ছাড়া আপনার জুড়ি নেই ।”

এ তো গেল ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস ও ছোটগল্পের কথা। কিন্তু গোয়েন্দাপ্রবর ব্যোমকেশ বক্সী মহাশয়কেই বা ভুলি কী করে! সেই শিক্ষিত তীক্ষ্ণধী সম্পন্ন বাঙালি যুবক যাকে স্বয়ং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তদন্তের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে দিল্লিতে ডেকে পাঠাতেন! মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যখন কলকাতা শহরে ক্রাইমের ধরণ বদলাচ্ছে, তখনই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে এলেন সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে যার মধ্যে একাধারে প্রতিভাত হল ক্ষুরধার বুদ্ধির দীপ্তি আর স্নিগ্ধ বাঙালিয়ানা। ব্যোমকেশ কাহিনীগুলিতে ঘনায়মান প্লটের দুর্ণিবার আকর্ষণ তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে সময়ের ছাপ আর মনস্তত্বের সূক্ষ্ম প্রয়োগ। বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, স্বাধীনতা, অবৈধ কোকেনের কারবার, চোরাই অস্ত্রের কালোবাজারী, জাল নোটের রমরমা- সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল সমাজ পরিবেশের ছবি ব্যোমকেশের কাহিনীগুলিতে ছাপ রেখে গেছে। সে অর্থে ব্যোমকেশ কাহিনীগুলিকে নিছক গোয়েন্দা কাহিনী হিসাবে না দেখে সামাজিক দলিল হিসাবেও দেখা যেতে পারে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই লিখেছিলেন- “এই কাহিনীগুলিকে আপনি শুধু সামাজিক উপন্যাস হিসাবেও পড়তে পারেন। “মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ ব্যোমকেশের অধিকাংশ কাহিনীতেই কমবেশি পাওয়া যায়। তবে সূক্ষ্ম মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োগ আমরা পাই দ্বিতীয় পর্বে লেখা তিনটি উপন্যাসে। সেগুলি হল- ‘বহ্নিপতঙ্গ’, ‘আদিম রিপ’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’।

প্রসঙ্গত, আর্থার কোনান ডয়েল, এডগার অ্যালান পো, আগাথা ক্রিস্টির তুলনায় দেশীয় ডিটেকটিভ সাহিত্যকে তাঁর নীম্নমানেরবলেই মনে হত।ছেলেবেলায়পাঁচকড়ি দে-র ‘নীলবসনা সুন্দরী’ পড়ে তাঁর মোটেও পছন্দ হয়নি। মনে করা যায় যে তিনি ডিকেটটিভ সাহিত্যকে সুসাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত করার একটা চ্যালেঞ্জই নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য ছিল, ‘‘ডিটেকটিভ গল্প যদি অপাংক্তেয় হয়, তবে historical romanceও অপাংক্তেয়। একটা অতীতের romance, অন্যটা বর্তমানের romance।’’

ঐতিহাসিক উপন্যাস এবং ব্যোমকেশ কাহিনী ছাড়াও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু সার্থক অলৌকিক রসের গল্প এবং হাসির গল্পও লিখেছিলেন। তাঁর লেখা বরদার গল্পগুলি, ‘দেহান্তর’ , ‘কালো মোরগ’ এর মতো অতিপ্রাকৃত রসের গল্প বা ‘তন্দ্রাহরণ’, ‘দাদার কীর্তি’র মতো হাসির গল্পগুলিও বাংলাসাহিত্যে তুলনারহিত হয়ে আছে ।এ কথা ঠিক যে জীবন যন্ত্রণা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় সেভাবে ছাপ ফেলেনি । আসলে মানব জীবনের অপার বৈচিত্র্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই লিখেছেন- “আমি গল্প রচনা করে পাঠককে আনন্দ দিতে চাই, রসসৃষ্টি করাই আমার স্বধর্ম। “এছাড়াও শরদিন্দু বম্বে টকিজ়ের ছবির জন্য ‘ভাবী’, ‘বচন’, ‘দুর্গা’, ‘কঙ্গন’, ‘নবজীবন’, ‘আজাদ’, ‘পুনর্মিলন’ গল্প লিখেছিলেন। বাংলায় ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘রাজদ্রোহী’ বা ‘শজারুর কাঁটা’ ছবি তৈরির অনেক আগে শরদিন্দুর লেখা চিত্রনাট্যে ‘দেবদূত’ (১৯৪৮) এবং ‘বিষের ধোঁয়া’ (১৯৪৯) ছবি হয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক ফরমায়েশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা তাঁর অসহ্য মনে হয়। তাই সিনেমার বোঝা মাথা থেকে পুরোপুরি নামিয়ে সত্যান্বেষীর প্রত্যাবর্তন ঘটে। শরদিন্দু ব্যোমকেশের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে ছিলেন। মাথায় রাখতেন, নিছক গোয়েন্দা কাহিনি নয়, ব্যোমকেশকে হতে হবে সামাজিক। থাকবে জীবনের ছবি, সময়ের ছাপ। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যোমকেশের গল্পে যদি সাহিত্যরস না থাকিয়া শুধু thrill ও শস্তা sensation থাকে, তবে সাহিত্যবিচারকগণ তাহাকে দ্বীপান্তরিত করুন, আপত্তি নাই।

                                        –

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version