শৈশবে একবার মারাত্মক ব্যাধি স্কারলেট জ্বরে ভোগার সময় কানে ইনফেকশন হয়েছিল তার। এর ফলে তাঁর শ্রবণ ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতে তিনি প্রায় বধির হয়ে যান। মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তীতে কোনো একসময় তিনি শৈশবের স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় তাঁর কানের শ্রবণ ক্ষমতা কমে গিয়েছিল! মিশিগানে শুরু হয়েছিল শিশুটির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে মাত্র ১২ সপ্তাহের জন্য! যে স্কুলে তিনি ভর্তি হন, সেই স্কুলের শিক্ষকরা ছেলেটিকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে পড়াতে আপত্তি জাননিয়েছিল। তখন তাঁর মা এই আপত্তির কারণ জানতে চাইলে শিক্ষকরা কেবল এতটুকুই বলেন, “Difficult to understand!”

ছেলেটিকে তাঁর শিক্ষকরা বুঝতে না পারলেও তার মা ঠিকই বুঝেছিলেন। তিনি ছেলেকে আর কোনো স্কুলে ভর্তি করাননি। বরং নিজে স্কুল শিক্ষিকা হবার সুবাদে বাড়িতেই ছেলেকে শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। ছেলেটির যখন ১১ বছর বয়স তখন থেকেই জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁর আর মাকে দরকার হয় নি। কারণ ততদিনে তাঁর জ্ঞানস্পৃহা অবিশ্বাস্য পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের অসংখ্য বই পড়তে শুরু করলেন এবং স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হবার প্রক্রিয়ায় নিজেকে সর্বোতভাবে যুক্ত করলেন। ভাবতে একটু অবাক লাগছে না? যে মানুষটির নামের পাশে রয়েছে ১০৯৩টি প্যাটেন্ট, তার কিনা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নেই! হয়তো এই জন্যই প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন যে প্রতিটি সুশিক্ষিত ব্যক্তিই স্বশিক্ষিত। তবে এই কথা জানার পর কেউ যেন আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে না ফেলেন। কারণ তিনি নিজেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রতি বছর মাধ্যমিক স্তরের সেরা শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের নামে স্কলারশিপ চালু করেছিলেন। তাই স্কুল ছেড়ে দিয়ে টমাস আলভা এডিসন হবার চিন্তা করাটা বোকামি।

এডিসন মাত্র এগারো বছর বয়সেই নিজের রসায়ন গবেষণাগার বানিয়ে নিয়েছিলেন। বাড়ির সেলারে তৈরি করা সেই গবেষণাগারে খুঁটিনাটি কাজ করে যেতেন আর পড়তেন অজস্র বই। ১২ বছর বয়সে তিনি ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রেইলরোড’ লাইনে সংবাদপত্র বিক্রয় করার চাকরি নেন। খুব দ্রুতই তিনি সংবাদপত্র বিষয়ক কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। এরপরেই নিজে একটি ছোট পত্রিকা ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক হেরাল্ড’ চালু করেন। চাকরি করার সময় কিন্তু নিজের গবেষণার কাজ ছাড়েননি। ট্রেনের একটি মাল-বগিতে গবেষণার জন্য জায়গা করে নেন! ট্রেনের বগিতে বসে গবেষণা করতে গিয়ে একদিন আগুন লেগে যায়। কিন্তু আগুন নেভানোর চেষ্টা করবেন কি! হঠাৎ করেই কানের নিচে প্রচণ্ড শব্দে ঘন্টা বাজিয়ে দিলেন ট্রেনের টিটি। হতবম্ব এডিসন ততক্ষণে ভয়ে কাঁচুমাচু। এরপ এডিসনের ট্রেনে পত্রিকা বিক্রয় বন্ধ হয়ে গেল। গবেষণাও বন্ধ হল। এই দুর্ঘটনাই আবার তাঁর ভাগ্য খুলে দিল। একটি তিন বছরের বাচ্চাকে ট্রেনে কাঁটা পরার হাত থেকে বাঁচালেন। শিশুটির বাবা তাঁকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। এডিসন চাইলেন টেলিগ্রাফ সম্পর্কে তার যত কৌতুহল আছে সব যেন মেটানোর ব্যবস্থা করেন ভদ্রলোক! সে ভদ্রলোকের সহায়তায় ১৫ বছর বয়সেই এডিসন হয়ে গেলেন একজন দক্ষ টেলিগ্রাফ অপারেটর। এরপর তিনি টেলিগ্রাফ সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করেন। ১৯ বছর বয়সী এডিসন লুইভিলে চলে আসেন এবং রাতের শিফটে টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি পান। রাতের শিফটে কাজ করায় গবেষণার জন্য যথেষ্ট সময় পেতেন এডিসন। কিন্তু বিপত্তি অন্যত্র, মানুষ টেলিগ্রাফারদের মুখে সংবাদ শুনতে চাইতো। কিন্তু এডিসনের ছিল কানে সমস্যা।

এবার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের চাকরি ছেড়ে এডিসন নিজের শহরে ফিরলেন। ফিরে এসেই দেখলেন পরিবারের দুর্দশা। বাবার চাকরি নেই, মা’র মানসিক অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। পরিবারের দায়িত্ব এবার নিজের কাঁধে নিতেই হবে। এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি চলে গেলেন বোস্টন। সেখানে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে চাকরি শুরু করলেন। অবসর সময়ের চিন্তা-ভাবনায় বানিয়ে ফেললেন একটি ভোট গণনাযন্ত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ম্যাসাচুসেটসের আইন প্রণেতারা যন্ত্রটির প্রতি কোনো আগ্রহই দেখাননি! এডিসন নিউ ইয়র্ক চলে আসেন। এখানে তিনি একটি ‘স্টক টিকার’ যন্ত্র উদ্ভাবন করেন যা একইসাথে একাধিক কাজ করতে পারতো। এডিসনের এই কাজে ‘দ্য গোল্ড অ্যান্ড স্টক কোম্পানি’ মুগ্ধ হয় এবং যন্ত্রটির স্বত্ব কিনে নিতে এডিসনকে ৪০ হাজার ডলার দেয়! এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এডিসন তার টেলিগ্রাফারের কাজ একেবারেই ছেড়ে দেন এবং উদ্ভাবক হিসেবে পুরোদমে কাজ শুরু করেন।

১৮৭৬ সালে নিউ জার্সির মেনলো পার্কে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের জন্য একটি বড়সড় গবেষণাগার ও যন্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এডিসন। এখানে ব্যবস্থা করেন উন্নত গবেষণার। আর মাত্র এক বছর পরই এখান থেকে তৈরি করেন ‘ফোনোগ্রাম’। উদ্ভাবনের সাথে সাথেই যন্ত্রটি দিকে দিকে সাড়া ফেলে দেয়। কয়েক বছরের মধ্যেই ফোনোগ্রামের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় এবং এডিসন আর্থিকভাবে ব্যাপক সফলতার মুখ দেখেন। একই বছর তিনি মেনলো পার্ক থেকে ‘কার্বন ট্রান্সমিটার’ও উদ্ভাবন করেছিলেন। এই কার্বন ট্রান্সমিটারের সাহায্যে তখন অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল কর্তৃক আবিষ্কৃত টেলিফোনের শ্রবণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক হিসেবে অধিকাংশ মানুষই থমাস আলভা এডিসনকেই চেনেন। কিন্তু ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। ১৮০০ সালে পৃথিবীর প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি। তার বাতিটি ছিল একটি আর্ক ল্যাম্প। তবে এডিসন বৈদ্যুতিক বাতির ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন এবং এমন একটি বাতি তৈরি করেন যা ডেভির আবিষ্কৃত বাতি থেকে অনেক বেশি আলো দেয়। তাছাড়া তিনিই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বাতি উৎপাদন শুরু করেন। সেজন্য অনেকে এডিসনকেই বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক বলতে চান।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version