রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস গ্রুপ বা রাগের রিপোর্ট অনুযায়ী সাংবাদিক আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় সব থেকে উপরে রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর। এরপর যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং ত্রিপুরা। রাগ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে গত একবছরে অন্তত ৬ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, ১০৮ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন, ৮ জন মহিলা সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এবং ১৩টি মিডিয়া হাউজ বা সংবাদ দফতর হিংসার শিকার হয়েছে।

কমিটি এগেন্সট অ্যাসাল্ট অন জার্নালিস্ট বা সিএএজে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে,উত্তর প্রদেশে গত ৫ বছরে১২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে, ১৩৮ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে, ৬৬ জনের বিরুদ্ধে হয় মামলা করা হয়েছে, নয় তো গ্রেফতার করা হয়েছে।যোগী আদিত্য নাথের জমানায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাংবাদিককে নানা ধরণের হুমকি দিয়ে, আইনি নোটিশ পাঠিয়ে, মামলা করে, আটক বা গ্রেফতার করে তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।

সাংবাদিকদের উপর হামলা প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় কর্ম সমিতির সহ-সভাপতি পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা সংবাদ মাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এখানে সবাই স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন।’ অথচ গত রবিবার পুরভোটে খবর সংগ্রহ করতে গিয়েই বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্ত হলেন একাধিক সংবাদ মাধ্যমের বহু সাংবাদিক। দুষ্কৃতীদের হামলায় অনেকে রক্তাক্ত হন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। আক্রমণ শুধুমাত্র মারধরয়েই থেমে যায়নি, চিত্র সাংবাদিকদের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। অধিকাংশ ঘটনাতেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের বিরুদ্ধে। 

ভোটের খবর সংগ্রহ করতেগিয়ে সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ নেমেছে আগেও। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ইসলামপুরে একইভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকরা। সেবার টিভির পর্দায় আমরা দেখেছিলাম গুন্ডাগিরির ছবি। ভোট প্রক্রিয়া চলাকালীন ইসলামপুরে দুষ্কৃতিরা সাংবাদিকের উপর তালিবানি হামলা চালিয়েছিল। সন্ত্রাসের সেই ছবি তুলতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন একটি বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের দুই সাংবাদিক।ওই সাংবাদিকদের গাছে বেঁধে, লোহার রড, বাঁশ দিয়ে মারা হয়। সাংবাদিকরা কেন সন্ত্রাসের ছবি তুলবে, তাই তাঁদের রাস্তায় ফেলে তালিবানি কায়দায় মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল। আশঙ্কা জনক অবস্থায় ওই দুই সাংবাদিককে ইসলামপুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেই গোটা ঘটনার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে।

রবিবারও পুরভোটে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে সাংবাদিক প্রকাশ সিনহা এবং তার সঙ্গী চিত্র সাংবাদিককে মাটিতে ফেলে মারা হয়। তাদের অপরাধ, তারাপ্রশ্ন করেছিলেন কাঁথির রহমানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে কেন জমায়েত হয়েছে। তার মানে সাংবাদিকরা জানতে চাইবেন না, কি হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে। জানতে চাওয়ার অপরাধে প্রথমে তাদের স্থানীয় হাসপাতালে তারপর তাদের কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।উত্তর দমদম পুরসভার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে মারধর করা হয় আরেক সাংবাদিক সৌরভ দত্ত ও চিত্রসাংবাদিক দীপঙ্কর জানাকে। তাদেরও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হালিশহরে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান সাংবাদিক অর্ঘ চট্টোপাধ্যায়। তারপরই তার বুকে, পিঠে ঘুষি মারা হয়।হালিশহরেই মার খান আরও এক সাংবাদিক এরপর তাদের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। হুগলির শ্রীরামপুরে আক্রান্ত হন সাংবাদিক সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই দিন আক্রান্ত হয়েছেন সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত গারুলিয়া পুরসভায় ২১ নম্বর ওয়ার্ডে, জলপাইগুড়ি পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে আক্রান্ত হয়েছেন সাংবাদিক প্রদ্যুৎ দাস ও চিত্র সাংবাদিক।

আক্রমণকারীরা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের একমাত্র পরিচয় তারা দুষ্কৃতী, তারা সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী দল বদল করে, দল তাদের নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগায়। এ ধরণের হামলা তারা আগেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। আর যারা আক্রান্ত তারা যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত হোন না কেন তারা সাংবাদিক। খবর সংগ্রহ করা তাদের কাজ।যে দল সাংবাদিকদের পিছনে দুষ্কৃতীদের লেলিয়ে দেয়, তালিবানি কায়দায় প্রহারে নিয়োগ করে আর যাই হোক রাজনৈতিক দল নয়, তারা গণতন্ত্রকে খুন করবে বলেই জেলায় জেলায় সাংবাদমাধ্যম এবং সংবাদ কর্মীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছেন এর আগেও এবং ভবিষ্যতেও চালাবেন। পুলিশ এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন নিশ্চয় তাঁদের পরিচয় বার করবে না এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাও নেবে না। কারণ তারা গণতন্ত্র হত্যাকারীদেরই দাস।

নির্বাচন কমিশন তো পুরভোটে ভোটে ১০ জন সিনিয়র আইএসকে বিশেষ পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করেছিল। পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে কি নির্বাচন কমিশন সেদিনের সাংবাদিক নিগ্রহের বিষয়ে কোনও রিপোর্ট তলব করেছে? নিশ্চয় না। আর যদি প্রথা অনুযায়ী করে থাকে তাহলে সেই বয়ান প্রকাশ্যে আনা হোক। সংবিধান, গণতন্ত্র, আইনি ব্যবস্থার ওপর যথেচ্ছ আঘাত ঘটবে আর নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব এড়িয়ে যাবে? আসলে সংবিধান, গণতন্ত্র নিয়ে যে সাধারণ মানুষ ঠাট্টা তামাশা করেন তার কারণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল বা দুষ্কৃতিরাই নয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সেখানকার ভাঁড়েরাও সমান ভাবে দায়ী।
Share.

5 Comments

  1. কলকাতা প্রেস ক্লাব মানে মদ্যপানের একটি ঠেক; সেটি যারা চালনা করেন তারা তো আর সাংবাদিক নন, তারা পুরভোট-সাংবাদিক নিগ্রহ এসব ঘটনা যে ঘটেছে তারা কোথা থেকে জানবেন। অনেকেই বলেছেন সাংবাদিকদের যারা মেরেছেন তাদের অনেকেই প্রেস ক্লাবের লোকজন…

  2. sarbendra bhoumik on

    সাংবাদিকদের নিগ্রহ মানে সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সে কাজ যারা করে বা করায় তারা গণতন্ত্রকে পিষে মারতে চায়। ফ্যাসিস্ট শাসক যুগে যুগে এই কাজ করে এসেছে।

  3. pradeep bagchi on

    সাংবাদিকরা ঠ্যাঙানি খেলে কার লাভ- শাসক দলের, বিরোধীদের না এই দুই পক্ষের দালালদের? আরও খোলসা করে বলুন, শত্রুদের চিহ্নিত করুন

  4. বিভিন্ন জেলা ও কলকাতার আশেপাশে পুরভোটের দিন দুষ্কৃতিরা সাংবাদিকদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছে তাতে সবথেকে আগে তো সাংবাদিকদেরই রাস্তায় নেমে তীব্র
    আন্দোলন করা দরকার ছিল, কিন্তু তা হলেও তেমন সাড়া ফেলেনি। অথচ তারাই সারা বছর সমাজ-রাজনীতির নানা খবর আমাদের সামনে হাজির করেন। কিন্তু সেভাবে আর কোনও সংগঠন এই নোংরা ঘটনার প্রতিবাদ করলো না, কিন্তু কেন???

  5. ranit sengupta on

    শুনেছি কলকাতা প্রেস ক্লাব নামক একটি সংস্থা আছে ময়দানে, সেখানে বহু নামি-দামী সাংবাদিকরা সমবেত হন, তারা নাকি দিনকে রাত; রাতকে দিন বানাতে পারেন কিন্তু যখন সহকর্মীরা পড়ে পড়ে মার খেল, ক্যামেরা, বুম কেড়ে নিয়ে ভাংচুড় হল তারপর তারা কি ভাবলেন বা করলেন। তারা নিশ্চয় মিউ মিউ করেন নি, গলা ফাটিয়েছেন কিন্তু কোথায়, তাদের গলার আওয়াজ কি কেউ শুনেছেন? প্রশ্ন আসল দুষ্কৃতি কারা, আমরা কাদের ধিক্কার দেব?

Leave A Reply

Exit mobile version