শুধু মণিপুর বা ভারতের থিয়েটার নয়, প্রাচ্য থিয়েটারের জীবন্ত কিংবদন্তি রতন থিয়াম। ঋতুসংহার, চক্রব্যূহ, উত্তর প্রিয়দর্শী, আশিবাগি ইশেইয়ের মতো নন্দিত নাটকের নির্মাতা তিনি। মণিপুরের ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’–এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান রতন থিয়াম কলকাতায় আসায় একটি টেলিভিশন চ্যানেল থেকে হাজির হয়েছিলাম তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। মাত্র দু-চারটি কথার জন্য তাঁর থেকে পনেরো বিশ মিনিট সময় চাওয়া হয়েছিল কিন্তু তা প্রায় ঘন্টা দেড়েক গড়িয়ে যায়, তিনিও তাঁর দেওয়া সময়ের কথা খেয়াল রাখেননি বরং বলতে চাইছিলেন আরও কিছু। অধিকাংশই আজ আর ভাল মনে নেই তবে মনে আছে অনেক কিছুই, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ।
তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলুম, প্রেক্ষাগৃহে দর্শকাসনে বসে যারা তাঁর থিয়েটার দেখেন তাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কী? মনে হল তিনি যেন একটু চিন্তায় পড়লেন, মনে হওয়ার কারণ তাঁর অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ বদলে গেল, তিনি খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিন্তু আদপে তা নয়, তিনি আমার দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলেন, আমি যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, এবার তিনি যা বললেন সেই কথাগুলি ছিল, তিনি প্রথমে নিজেকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন এই ধরনের দু-একটি প্রশ্ন করে যেমন এই থিয়েটার কি সমাজের রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সমর্থ, আদৌ কি থিয়েটার তেমনটা হওয়া উচিত যেমন বাতাসের মধ্যে সতেজতা থাকা উচিত, যথেষ্ট রকম নান্দিকতা থাকা উচিত ইত্যাদি প্রভৃতি। তিনি অনেকগুলি কথাই বলে গেলেন যার থেকে আমি অনায়াসেই বুঝলাম তিনি স্পষ্ট ভাবেই বললেন যে থিয়েটার আসলে তাঁর কাছে বা তাঁর জন্য এক অর্থে একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা। তিনি সেটাই দর্শকদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
তাঁর বলা কথাগুলির মধ্যে থেকে আমি আধ্যাত্মিক যাত্রা কথাটিকে একটু আলাদা করে নি এবং তাঁর থেকে বিষয়টি একটু বিষদে জানতে চাই। তিনি প্রথমেই বলেন হ্যাঁ, থিয়েটারের মধ্যে আধ্যাত্মিক একটা বিষয় আছে, অতি অবশ্যই আচ্ছে, তুমি এর মানে কীভাবে করবে আমি জানি না তবে এটা আছে। কারণ থিয়েটার চর্চা বা শিল্পচর্চা তুমি যেভাবেই করতে চাও, তা করতে গেলে তোমাকে শিল্পবোধ বা নান্দনিকতার কাছে যেতে হবে একই সঙ্গে যেতে হবে মানুষের কাছে। কিন্তু তার কাছে কি যাওয়া হয়? গিয়েও কিন্তু যাওয়া হয় না। কেননা, যতই কাছে যাবে, ততই সে দূরে সরে যাবে। এ যেন এক লুকোচুরি খেলা, আর এই যে নান্দনিকতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা তা খেলতে খেলতে পাহাড়ে উঠতে গেলে আধ্যাত্মিক উপাসনা করতেই হবে, তা না হলে ওখানে কেউ পৌঁছাতে পারবে না। আমি আধ্যাত্মিক উপাসনা বলবো কারণ আমরা কিন্তু বহু সময়েই এই উপাসনা করে থাকি। একে তুমি স্যাক্রিফাইস বলতে পারো কিংবা আত্মনিবেদন যাই বলো না কেন তা করতে হবে। এসব কথা বলতে বলতে তিনি বলে উঠলেন, ‘সওদাগরি নেহি হে, এবাদত খোদা কি হে/ এ বেখবর জাজা কি তামান্না ভি ছোড় দে…’। এর মানে জানতে চাইলাম, বললেন, ব্যবসা নয়, আমি খোদার এবাদত করছি। হে অজ্ঞ, ফলের আশা ছেড়ে দাও। এবাদত করে তুমি ফল পাবে, এই আশাও তুমি ছেড়ে দাও। এই যে দু’টাকা, পাঁচ টাকা দিয়ে আমরা বলি, আমাকে এটা করে দাও, ওটা করে দাও… এগুলো বাদ দিতে হবে। থিয়েটারের কাজ করতে গেলে সেখান থেকে বস্তুগত ফলের আশা ছেড়ে দিতে হবে।
সবভাবতই প্রশ্ন এসে পড়ে তাহলে কিসের আশায় থিয়েটার? ফের একবার গম্ভীর হলেন, বলা ভাল বেশ খানিকটা আত্মমগ্ন হলেন, নিজের দুটি হাতের আঙুলগুলির দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর মুখ তুলে হাসি মুখে বললেন, অনলি থিয়েটার, অ্যান্ড থিয়েটার অ্যান্ড থিয়েটার… নিজেকেই প্রশ্ন করলাম এর মানে কি আত্মশুদ্ধি বা আত্মনিবেদন, তার কথাই কি তিনি বলছেন বা বোঝাতে চাইছেন?
তিনি ফের বলতে শুরু করলেন, তোমার দর্শকের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রসঙ্গে এও বলতে চাই যে আমি কোনোদিন দর্শকের জন্য থেয়েটার করি না, আমি মনে করি আমি যে থিয়েটার করি তা নিজের জন্য। থিয়েটারে আমি আমাকে বা নিজেকে দেখতে চাই। কারণ এবাদত বলো বা উপাসনা বা পুজো যাই বলো না কেন সেটা করতে গেলে আমি একাই তো করি, মানুষ কিংবা দর্শককে দেখিয়ে-বসিয়ে তো আর করি না। একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, এটা একটা অন্তহীন যাত্রা, যার কোনো শেষ নেই। থিয়েটার করতে গেলে তিন-চার-পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগের ইতিহাস, স্থাপত্য সম্পর্কে জানতে হয়। জানতে হয় ট্র্যাডিশনাল ফর্মগুলো, গ্রিক থিয়েটার, নো থিয়েটার, কাবুকি থিয়েটার, বেইজিং অপেরা—সবই একটু একটু করে জানতে হয়। এখন এই ফর্মগুলো ইন্টারনেটের সৌজন্যে আমরা চাইলেই দেখতে পাই, অনেকে দেখেও, আমিও দেখেছি, দেখিও, একটু একটু করে শেখাও হয়। তবে এখন অভিনয়শৈলীগুলির মধ্যে নানা ধরনের পরিবর্তন আসছে, আজ থেকে দশ-বিশ বছর আগে যে রকমটা ছিল, ওই অভিনয়শৈলীগুলি ধীরে ধীরে হলেও বদলাচ্ছে, আরও বদলাবে। যাবে। সময় একটি জরুরি বিষয়, সেটাকে কেউই আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না, পারছিও না। আগে মানুষ তিন-চার ঘণ্টা ধরে থিয়েটার দেখত, এখন কিন্তু মানুষকে এক ঘণ্টার থিয়েটার দেখতেও ভাবতে হচ্ছে, সে চাইলেও পারছে না। পকেটে একটি যন্ত্র রাখা আছে, সেটি কখন বেজে উঠবে, মাথা থেকে সেই চিন্তাটি কিন্তু একেবারে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এতে কিন্তু অবস্থাটি আগের চেয়ে কিছুটা হলেও আলাদা হয়ে গিয়েছে।
এতো আপনি টাইম ফ্যাক্টরের কথা বলছেন. হ্যাঁ একদমই তাই, কারণ এই অবস্থাটি আমাকে বুঝতে হবে এবং সেটি বুঝেই আমাকে কাজ করতে হবে। কেবল তাই নয়, ওই অবস্থাটি আমাকে জানতে-বুঝতে হবে, এর জন্য টাইম ফ্যাক্টরস, বিশ্বায়ন— সবই বুঝতে হবে। যেমন: এই মার্বেল-আর্কিটেকচারের কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, ডিজাইন, কালারে কতটা পরিবর্তন এসেছে— সব কিছুই জানতে-বুঝতে হবে। দুনিয়ার এমন কোনো বিষয় বা ধ্যান-ধারণাক নেই, থিয়েটার করতে গেলে যা থিয়েটারের কাজের মধ্যে আসবে না। তাই প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। থিয়েটার করতে গেলে পড়াশোনা করাটা খুবই জরুরি। আমি তো বিশ্বাস করি দর্শকেরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান,। আমাকে দর্শকের কাছে পৌঁছাতে হবে, আমি যদি দর্শকদের কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারি, আমার মাথাটা ওঁদের সমান রাখতে না পারি, তবে সেটা খুবই খারাপ ব্যাপার হবে। সবশেষে একটি কথা বলবো, নিজের বলে একটা ব্যাপার আছে, কতটুকু আমি চাই… আমরা বলতেই পারি না, ঠিক কতটা চাই আমার… তবে তুমি যদি কাজটা এনজয় করো, তাহলে করো।