এখন একটি গান (সিনেমা অথবা বেসিক) রেকর্ডিং করার আগেগানের সুরকার সেই গানের সঙ্গীত শিল্পিকে কতবার রিহার্সাল করান? পাঁচ বার, দশ বার কিম্বা তার থেকেও কম বা বেশি হয়ত। আজ থেকে বিরাশি বছর আগের কথা। ১৯৪৯ সালে বোম্বাইয়ের ছবি ‘আন্দাজ’, মেহবুব খান পরিচালিত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, নার্গিশ প্রমুখ, ওই ছবির একটি গান ‘তু কাহে অগর’, গীতিকার মজরু সুলতানপুরি, গানটি মুকেশকে দিয়ে রেকর্ডিং করানোর আগে সুরকার তেইশ দিন রিহার্শাল করিয়েছিলেন। রিহার্শাল হত সুরকারের বাড়িতে, আর তার জন্য মুকেশকে প্রতিদিন লম্বা পথ পেরিয়ে যেতে হত সুরকারের বাড়িতে। এরপর সেই গান রেকর্ডিং হয়, কিন্তু স্টুডিও থেকে বেরিয়ে মুকেশ যখন সঙ্গীত পরিচালকের সামনে এসে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চান তখন সুরকার জানান, আরও কয়েকটা রিহার্সাল আর টেক হলে ভাল হত।

এই ঘটনার পাঁচ বছর পর মেহবুব খানের ‘অমর’ ছবিতে সুর করেছিলেন ওই একই সুরকার।দিলীপ কুমার, মধুবালা, নিম্মী অভিনীত সেই ছবিতে শাকিল বদাউনি-র লেখা ‘তেরে সদকে বালম না কর কোই গম ইয়ে’ গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। লতা ওই গানটির রেকর্ডিং নিয়ে জানান, রেকর্ডিং ওকে হয়ে যাওয়ার পর সুরকার তাঁকে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর সুরকার স্টুডিওতে একা বসে গানটি অনেক বার শোনেন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে জানান ‘ইয়ে’ কথাটির সুরের মুড়কিটা ঠিক হয়নি। অতএব ফের রেকর্ডিং। একের পর এক টেক নেওয়া হয়। কিন্তু সুরকারের মন ভরে না। লতা শারীরিক ভাবে এতটাই বিধ্বস্ত হন যে রেকর্ডিং করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বভাবতই কিছুক্ষণ বিশ্রাম ফের রেকর্ডিং। বেশ কয়েকটি টেকের পর লতা সেই সুরকারকে খুশি করতে পারেন।

একটি গানের কথা হাতে পেয়ে তাতে সুর করে, শিল্পীকে রিহার্শাল করিয়ে রেকর্ডিং স্টুডিওতে পৌছতে ওই সুরকার এত সময় নিতেন যে বছরে খুব বেশি হলে তিনি দুটি ছবির কাজ করতে পারতেন। সেখানে অন্য সুরকাররা বছরে আধ ডজন কাজ সেরে ফেলতেন। যতক্ষণ না তার মনে হত গানটি হয়েছে ততক্ষণ তিনি চেষ্টা চালাতেন। অনেক পরিচালক আবার ওঁর জন্যই অপেক্ষা করতেন। এই ভাবে কাজ করায় সঙ্গীত জীবনে কাজের সংখ্যা মাত্র ৬৭। তবে তারমধ্যে ২৫টি রজত জয়ন্তী, ৯টি সুবর্ণ জয়ন্তী এবং ২টি হীরক জয়ন্তীর গৌরব অর্জন করে।

এসএম শ্রীরামুলু নাইডু পরিচালিত, দিলীপ কুমার আর মীনা কুমারীঅভিনীত ‘আজাদ’ ছবিটির প্রযোজক আলোচিত সুরকারকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন কুড়ি দিনের মধ্যে গানগুলির সুর করে দেন, বিনিময়ে তিনি তাঁকে এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক দেবেন। সুরকার ওই প্রযোজককে প্রায় তাড়িয়ে দিয়ে বলেন, তাঁর একটি গানের সুর করতেই কম করে কুড়ি দিন লেগে যাবে। শেষ পর্যন্ত ‘আজাদ’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেন সি রামচন্দ্র।

এই সুরকার ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবিতে তানসেন চরিত্রের লিপে শকিল বাদাউনির লেখা ‘শুভ দিন আয়ো রাজ দুলারা’ ও ‘প্রেম জোগান বন কে’ দুটি গানের জন্য ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানকে নির্বাচন করেন। সিনেমার গান শুনে বড়ে গুলাম পিছিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত অনুরোধ রক্ষা করেন। তবে মাত্র দুটি গানের জন্য পঁচিশ হাজার টাকা যা সেদিনের পক্ষে অবিশ্বাস্য। ছবির প্রযোজক ও পরিচালক কে আসিফ শেষমেস রাজি হন। সেই সময় বোম্বাইয়ে সিনেমার গানে সর্বাধিক পারিশ্রমিকের শিল্পী লতা মঙ্গেশকর পেতেন পাঁচশো টাকা।

এই সুরকার তাঁর কাজে কারও হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করতেন না। আজকের মতো কোনও প্রযোজক বা পরিচালক তাঁকে দিয়ে ফরমায়েশি গান প্ররোচিত করতে সাহস পেতেন না। ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘আন্দাজ’, ‘আন’, ‘অমর’, ‘আওরত’ প্রভৃতি বিখ্যাত ছবির সিনেমা পরিচালক মেহবুব খান একবার তার একটি ছবির মিউজিক স্কোরিঙের সময় তাঁকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরের দিন তিনি মেহবুবের শুটিং ফ্লোরে গিয়ে ক্যামেরায় চোখ রেখে নানা কথা বলতে থাকেন। মেহবুব তাঁকে জিঙ্গেস করেন, ‘আপনি এখানে কি করছেন?’ সুরকার জানান, ‘আপনি কাল যা করছিলেন, টাইম পাশ’।

এমন বহু গল্প আছে মুম্বাই সিনেমার সঙ্গীতকার নওশাদ সম্পর্কে। নওশাদই প্রথম ‘রতন’ ছবিতে একটি গানে সফলভাবে ইকো ব্যবহার করেছিলেন ফাঁকা বন্ধ ঘরে রেকর্ডিং করে। ‘আন’ ছবির একটি গানে সিম্ফনি অক্রেষ্ট্রার মেজাজ তৈরি করতে ১০৬ জন বাদ্যযন্ত্রী ব্যবহার করেছিলেন, ‘উড়ন খটোলা’ ছবির‘মোরে সইয়া জি উতরেঙ্গে পার হো নদীয়া’ গানটিতে যন্ত্রানুষঙ্গের পরিবর্তে ব্যবহার করেছিলেন ১০০ কন্ঠের কোরাস। কয়েক বছর আগেও বছরে কোটি টাকার রয়্যালটি জমা হত নওশাদের নামে।
Share.

2 Comments

  1. shanti ranjan biswas on

    ভাল লেখা মানে অজানা কথা জানা, খুব সুন্দর করে তার উপস্থাপন, সাধারণ হলেও তা মনে থেকে যাবে- এই লেখাটি চমৎকার ও অনবদ্য।

  2. আশ্চর্য মনে হলেও শিল্প এভাবেই সৃষ্টি হয়, সেই শিল্প সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত কারিগরের প্রকৃত শিল্পী। এসব আজকের গায়ক-সুরকারদের কল্পনার বাইরে।

Leave A Reply

Exit mobile version