পিনাকী দত্ত, নিউ জার্সি

২৪ বছর হয়ে গেল আমার প্রবাসী জীবনের – দৈনন্দিন জীবন চর্যার অভিজ্ঞতাটা এখানে অনেকটাই যে আলাদা সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এমন একটা সময়ে লেখাটা লিখতে বসলাম যখন প্রবাস পরবাস সব বিভেদই ঘুচে গেছে। জীবন মৃত্যুর একটা সূক্ষ দাড়িপাল্লায় দুলছি আমরা সবাই । বলিউডের শাহেনশা থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট থেকে, ইতালির ফুটবলার – একরত্তি একটা ভাইরাস গোটা পৃথিবীকে একটা বৃত্তে এনে দাঁড় করিয়েছে – জাতি ধর্ম অর্থ বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে । অথচ, সেই বৃত্তে দাঁড়িয়েও, ২০২০-র অতিমারী আক্রান্ত বিশ্বকে গর্জে উঠতে হয়ে ‘can’t breathe’ বা ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স ‘ স্লোগানে। পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন কোনও কালো মানুষের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ঠিক তখনই কোথাও, অন্য কোনও প্রান্তে, চিকিৎসা না পেয়ে ষোলো বছরের কিশোর মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। কি অদ্ভূত সমাপতন, কি বৈপরীত্য। যাই হোক সে অন্য প্রসঙ্গ, অন্য আলোচনা। কোন জীবন যে কতটা গুরুত্ব রাখে, এই অতিমারী তো সেই বোধ টাই গুলিয়ে দিয়েছে। তবে একই সাথে এই কঠিন সময় হয়তো আমাদের সবাইকেই বেশ কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য করেছে আমাদের priorities of life।

বারবার শুনেছি nature is a great leveler. প্রায় দেড় দশক আগে প্রথম বার আলাস্কা বেড়াতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি করে যা মনকে নাড়া দিয়েছিলো তা হলো ইকোসিস্টেম এর ন্যাচারাল ব্যালান্স। স্যামন মাছের ডিম্ পাড়ার সময় হলে, জীবন বাজি রেখে পাহাড়ি নদীতে স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতরে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা, বা বড় চেহারার গ্রিজলি ভালুকের থাবা থেকে বাঁচার জন্য সাদা ভেড়ার দলের পাহাড়ের মাথায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া; ছবির মতো নীল বরফের হিমবাহ ভেঙে, রাস্তার পাশে পাশে হাত ধরে চলতে থাকা সমুদ্রে মেশা, বা দাবানলে পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া হাজার হাজার একর কালো জঙ্গলের মাটিতে ফুটে ওঠা গোলাপি ফুল – প্রকৃতির নিজের নিয়মেই সবার যেন কি সুন্দর সহাবস্থান। গত বছর দ্বিতীয় বার আলাস্কা গিয়ে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো – চোখে লেগে থাকা পনেরো বছর আগের ছবিগুলো মেলাতে পারিনি অনেকটাই। সমুদ্র বেশ কয়েক জায়গায় রাস্তা থেকে দূরে সরে গেছে, বাড়তে থাকা আবর্জনা আর পলির সাথে লড়তে না পেরে – যেনো কিছুটা অভিমানেই। ডেনালি ন্যাশনাল পার্ক এ ভালুকের পরিবার নিয়ে দীপ্ত পদচারণা কমে গেছে -যাদের দেখতে পেলাম, তারাও যেন কিছুটা ভয়ে ভয়েই চলছে মাটির দিকে ঝুঁকে। পাহাড়ের মাথায় বরফও অনেক কম। ফিরতে ফিরতে ভেবেছিলাম, আর যাবো না – বছর দশেক বাদে গিয়ে হয়তো দেখবো নস্টালজিয়াটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে আছে। তার থেকে ভালো স্মৃতি গুলো যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখি, গতবার দেখতে পাওয়া রাতের পিচকালো অন্ধকার আকাশে রংবাহারি সুমেরু আভার মতোই।

সেদিন দেখলাম সকালে আমার বাড়ির লন এর বেড়ার পাশে, তিনটে হরিন আর দুটো টার্কি পাখি। আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে ডেকে নিলাম দেখাবো বলে। ওরাও আমাদের গলা শুনে খুব ঘাবড়ে দূরে সরে গেলোনা। কদিন ধরেই শুনছিলাম, গঙ্গায় ডলফিন ফিরে এসেছে। হিমালয়ের বরফে ঢাকা চূড়া অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ভেনিসের ক্যানালের স্বচ্ছ জল এ নাকি দেখা যাচ্ছে সাঁতরে বেড়ানো জেলি ফিশ। কোনো এক ব্যস্ত শহরের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেছে ময়ূরের অলস হাঁটা চলায়। এর কতটা সত্যি, আর কতটা মানুষের কল্পনা আর ইচ্ছেশক্তির মিশেল, সেই তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন কি? তার চেয়ে বরং এটাই ভাবতে ভালো লাগে – এমন কেন সত্যি হয়না আহা?

লকডাউন এর সময় ভেনিসের ক্যানেলে জেলীফিশ

স্যামন মাছের ডিম্ পাড়ার সময় হলে, জীবন বাজি রেখে পাহাড়ি নদীতে স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতরে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা, বা বড় চেহারার গ্রিজলি ভালুকের থাবা থেকে বাঁচার জন্য সাদা ভেড়ার দলের পাহাড়ের মাথায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া; ছবির মতো নীল বরফের হিমবাহ ভেঙে, রাস্তার পাশে পাশে হাত ধরে চলতে থাকা সমুদ্রে মেশা, বা দাবানলে পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া হাজার হাজার একর কালো জঙ্গলের মাটিতে ফুটে ওঠা গোলাপি ফুল – প্রকৃতির নিজের নিয়মেই সবার যেন কি সুন্দর সহাবস্থান।

আমরাও কি আরো অনেক কিছু পাচ্ছি না, যা হয়তো জীবনের প্রতিদিন থেকে প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল? দিনের যাতায়াতের থেকে বেঁচে যাওয়া যে দুই বা তিন ঘন্টা নিজের ভালোলাগা গুলোকে দিতে পারছি, পরিবারের সঙ্গে কাটাচ্ছি কিছুটা বাড়তি সময়; কেউ হয়তো নতুন রান্নায় হাত পাকাচ্ছি, বা অনেকদিন না পড়া, ধুলো জমে যাওয়া বইটাকে ঝেড়ে নিয়ে আবার নতুন চশমা চোখে পড়ছি। সেদিন এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিলো – দুজনেই একমত হলাম – আমরা কত বাড়তি অবান্তর খরচ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। সেগুলো আর করছিনা, করতে পারছিনা বলেই হয়তো! কিন্তু কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা ঐচ্ছিক, ভাবছি তো নতুন করে! সেটাই বা কম পাওয়া কি? প্রযুক্তি কে কতরকম ভাবে নতুন আঙ্গিকে প্রয়োগ করার চেষ্টা হচ্ছে সে নাহয় তোলা থাকে আরেক লেখার জন্য।

পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত মহামারী অতিমারীর মতো এই সময়টাও পেরিয়ে যাবে. আমরাও ফিরে যাবো আমাদের নৈমিত্যিক ব্যস্ততায়। আকাশে বিমান চলাচল বাড়বে, বাড়বে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা – ধ্বসে যাওয়া তেলের বাজার আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে, অর্থনীতির মন্দাও সময়ের সাথে যাবে কেটে। কিন্তু গত কয়েক মাসের প্রকৃতির এই rebalancing act যদি আমাদের একটুও ভাবাতে পারে, তাহলে হয়তো আকাশের এই নীল রংটা থেকে যাবে আমাদের সাথেই। বছর দশেক বাদে আলাস্কাটা আরেকবার ঘুরে আসবো তবে – ভাবতে ক্ষতি কি!

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version