উপত্যকায় সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ২২ এপ্রিল জম্মু–কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার জেরে দুই দেশ পাল্টাপাল্টি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত সিন্ধু জল বণ্টন চুক্তি, বাণিজ্য, ভিসা ও আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি স্থগিত করেছে। পাল্টা পাকিস্তানও সিমলা চুক্তি, বাণিজ্য, ভিসা ও আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি স্থগিত করেছে। সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে টানা আট দিন রাতের বেলা গোলাগুলি হয়েছে। যদিও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি কিন্তু টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। উভয় পক্ষই নিয়ন্ত্রণ রেখা জুড়ে গুলি বিনিময় করছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করছে। এই পরিস্থিতি দুই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের মধ্যে বৃহত্তর সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা বেড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধ হযয়েছে, তারমধ্যে প্রায় সব যুদ্ধই কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে। দেখা যাক এ পর্যন্ত কতগুলি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে-

১৯৪৭-৪৮ সালে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একে কাশ্মীর যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। কারণ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ মূলত কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে হয়েছিল। তৎকালীন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের মহারাজা ছিলেন হিন্দু। পাকিস্তান সেই সময় কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ করতে স্থানীয় মিলিশিয়াদের সমর্থন দেয়। অন্যদিকে মহারাজা ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন, ফলে ভারত সরসারি কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করে। এর জেরে ভারতীয় বাহিনী এবং পাকিস্তান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও যোগ দেয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। সমঝোতার ভিত্তিতে কাশ্মীরকে বিভক্ত করে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) টানা হয়। ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, বাকি অংশ (আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালটিস্তান) পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে জাতিসংঘ গণভোটের আহ্বান জানায়। কিন্তু ভারতের আপত্তিতে তা আর কখনো হয়নি। ফলাফল হল অচলাবস্থা। তারপর থেকেই কাশ্মীর একটি সংঘাতপূর্ণ এলাকা। বলা যায় ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধের প্রধান কেন্দ্র হল এই ভূখণ্ড।

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বিতীয়বার সংঘাত বাধে ১৯৫৬ সালে। কচ্ছ যুদ্ধ: ১৯৫৬ সালে দ্বন্দ্বটির সূচনা হয়। পরে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীরা ভারত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পাহারা দিতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালের ৮ এপ্রিল উভয় দেশই ‘কচ্ছ’ অঞ্চলে একে অপরের সীমান্ত চৌকির ওপর আক্রমণ চালায়। প্রথমে শুধু উভয় দেশের সীমান্ত পুলিশরা এ সংঘর্ষে জড়িত হয়। পরে খুব দ্রুত উভয় দেশের সশস্ত্রবাহিনীও জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালের জুনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন দেশ দু’টিকে সংঘর্ষ বন্ধ করতে রাজি করান। তিনি বিরোধটির নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ১৯৬৮ সালে ট্রাইব্যুনালের রায়ে পাকিস্তান দাবিকৃত ৩,৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার ভূমি লাভ করে।

১৯৯৯ সালের মে-জুলাই মাসে কাশ্মীরের কার্গিল জেলায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি ফৌজ ও কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ডি ফ্যাক্টো সীমান্তরেখা হিসেবে পরিচিত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অব কন্ট্রোল পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়লে এ যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। যুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধের পরে পাকিস্তান এ যুদ্ধের দায় সম্পূর্ণ কাশ্মীরি স্বাধীনতাপন্থী জঙ্গিদের ওপর চাপিয়ে দেয়। তবে ফেলে যাওয়া তথ্য-প্রমাণ এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট জানা যায়, পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনীও এ যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। শেষে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থনের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পাকিস্তানকে ফৌজ প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব। যা ক্রমশই যুদ্ধের দিকে মোড় নেয়। কাশ্মীরের পুলওয়ামা উপত্যকায় পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের হামলায় একসঙ্গে ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। যার ফলে ভারতও পাল্টা হামলা চালাতে বাধ্য হয়। সেই হামলা-পাল্টা হামলাই তখন বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে মোর নেয়।

এছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কতগুলি সংঘাত ও উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যেমন সিয়াচেন ১৯৮৪ সালে সিয়াচেন সংঘাত। ভারত ১৯৮৪ সালে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিয়াচেন হিমবাহে (এটি বিশ্বের উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র) দুই দেশই সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। এখনো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটে, তবে কোনো বড় যুদ্ধ হয়নি। হিমবাহের বেশিরভাগ অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে সংঘর্ষও মাঝেমধ্যে লেগে থাকে। নিয়ন্ত্রণ রেখায় ঘন ঘন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন, বিশেষ করে ২০০০ এবং ২০১০ সালে আর্টিলারি (ভারী গোলা) ও হালকা অস্ত্রের গোলাগুলি হয়। উত্তেজনার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে ২০১৬ সালের উরি হামলা এবং ২০১৯ সালের বালাকোট বিমান হামলা হয়। তার আগে ২০০১–০২  সালে ভারতের জাতীয় সংসদে হামলা হয়। এই হামলার জন্য পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জয়শ-ই-মহাম্মদকে দায়ী করে ভারত। এই হামলায় এক জন সাধারণ নাগরিকসহ বারো জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর উভয় দেশ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে। কূটনৈতিক চাপে ১০ মাসের অচলাবস্থার অবসান ঘটে এবং যুদ্ধ এড়ানো যায়।

২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়। এরপর ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে কথিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়। পাকিস্তানের বিমান বাহিনী পাল্টা জবাব দেয়, ফলে একটি সংক্ষিপ্ত বিমান যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে গিয়ে একজন ভারতীয় পাইলট আটক হন। পরে অবশ্য তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। এই ঘটনার প্রভাব সেভাবে আঞ্চলিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। উভয় পক্ষই বিজয় দাবি করে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version